পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ \O8 S) “না সময় হয় নি” বলে কুমুকে ইশারা করে বিছানার পাশের চোঁকিতে বসালে। আপনার হাতে তার হাত তুলে নিয়ে বললে, “কুমু, আমার কাছে খুলে বল, কী রকম চলছে তোদের।” তখনই কুমু কিছু বলতে পারলে না। মাথা নিচু করে বসে রইল, দেখতে দেখতে মুখ হল লাল, শিশুকালের মতো করে বিপ্রদাসের প্রশস্ত বুকের উপর মুখ রেখে কেঁদে উঠল ; বললে, "দাদা, আমি সবই ভুল বুঝেছি, আমি কিছুই জানতুম না।” বিপ্রদাস আস্তে আস্তে কুমুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। খানিক বাদে বললে, “আমি তোকে ঠিকমত শিক্ষা দিতে পারি নি। মা থাকলে তোকে তোর শ্বশুরবাড়ির জন্যে প্রস্তুত করে দিতে পারতেন।” কুমু বললে, “আমি বরাবর কেবল তোমাদেরই জানি, এখান থেকে অন্য জায়গা যে এত বেশি তফাত তা আমি মনে করতে পারতুম না। ছেলেবেলা থেকে আমি যা-কিছু কল্পনা করেছি সব তোমাদেরই ছাচে । তাই মনে একটুও ভয় হয় নি। মাকে অনেক সময়ে বাবা কষ্ট দিয়েছেন জানি, কিন্তু সে ছিল দুরন্তপন, তার আঘাত বাইরে, ভিতরে নয়। এখানে সমস্তটাই অন্তরে অন্তরে আমার যেন অপমান ।” বিপ্রদাস কোনো কথা না বলে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে চুপ করে বসে ভাবতে লাগল। মধুসূদন যে ওদের থেকে সম্পূর্ণ আর-এক জগতের মানুষ, তা সেই বিবাহ-অনুষ্ঠানের আরম্ভ থেকেই বুঝতে পেরেছে। তারই বিষম উদ্বেগে ওর শরীর যেন কোনোমতেই সুস্থ হয়ে উঠছে না। এই দিওনাগের স্কুলহস্তাবলেপ থেকে কুমুকে উদ্ধার করবার তে। কোনো উপায় নেই। সকলের চেয়ে মুশকিল এই যে, এই মানুষের কাছে ঋণে ওর সমস্ত সম্পত্তি বাধা । এই অপমানিত সম্বন্ধের ধাক্কা যে কুমুকেও লাগছে। এতদিন রোগশয্যায় শুয়ে শুয়ে বিপ্রদাস কেবলই ভেবেছে মধুসূদনের এই ঋণের বন্ধন থেকে কেমন করে সে নিস্কৃতি পাবে। ওর কলকাতায় আসবার ইচ্ছে ছিল না, পাছে কুমুর শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে ওদের সহজ ব্যবহার অসম্ভব হয়। কুমুর উপর ওর যে স্বাভাবিক স্নেহের অধিকার আছে, পাছে তা পদে পদে লাঞ্ছিত হতে থাকে, তাই ঠিক করেছিল কুরনগরেই বাস করবে। কলকাতায় আসতে বাধ্য হয়েছে অন্য কোনো মহাজনের কাছ থেকে ধার নেবার ব্যবস্থা করবে বলে । জানে ষে এটা অত্যন্ত দুঃসাধ্য, তাই এর দুশ্চিন্তার বোঝা ওর বুকের উপর চেপে বসে আছে ।