পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

et w9Sዓ গৃহিণীর তৎক্ষণাৎ বিন্ধবাসিনীর শয়নকক্ষের বিলাতি তেলের ছবি মনে পড়িল-অপর্যাপ্ত অবজ্ঞার স্বরে কহিলেন, “আমরে যাই। এ তোমার বৈঠকখানায় রাখিয়া বসিয়া বসিয়া নিরীক্ষণ করোগে। এ আমার কাজ নাই।” বিমৰ্ষ বৈদ্যনাথ বুঝিলেন অন্যান্য অনেক ক্ষমতার সহিত শ্ৰীলোকের মন জোগাইবার দুরূহ ক্ষমতা হইতেও বিধাতা তাহাকে বঞ্চিত করিয়াছেন। ; এদিকে দেশে যত দৈবজ্ঞা আছে মোক্ষদা সকলকেই হাত দেখাইলেন, কোষ্ঠী দেখাইলেন। সকলেই বলিল, তিনি সধবাবস্থায় মরিবেন। কিন্তু সেই পরমানন্দময় পরিণামের জন্যই তিনি একান্তব্যগ্র ছিলেন না, অতএব ইহাতেও তঁহার কীেতুহল নিবৃত্তি হইল না। : 朝 শুনিলেন। তঁহার সন্তানভাগ্য ভালো, পুত্রকন্যায় তাহার গৃহ অবিলম্বে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিবার সম্ভাবনা আছে ; শুনিয়া তিনি বিশেষ প্রফুল্লতা প্রকাশ করিলেন না। অবশেষে একজন গনিয়া বলিল, বৎসরখানেকের মধ্যে যদি বৈদ্যনাথ দৈবক্ষন প্রাপ্ত না হন, তাহা হইলে গণক তাহার পাজিপুঁথি সমস্তই পূড়াইয়া ফেলিবে । গণকের এইরূপ নিদারুণ পণ শুনিয়া মোক্ষদার মনে আর তিলমাত্র অবিশ্বাসের কারণ রহিল না । গনৎকার তো প্রচুর পরিতোধিক লইয়া বিদায় হইয়াছেন, কিন্তু বৈদ্যনাথের জীবন দুর্বাহ হইয়া উঠিল। ধন উপার্জনের কতকগুলি সাধারণ প্রচলিত পথ আছে, যেমন চাষ, চাকরি, ব্যাবসা, চুরি এবং প্রতারণা। কিন্তু দৈবধন উপার্জনের সেরূপ কোনো নির্দিষ্ট উপায় নাই। এইজন্য মোক্ষদা বৈদ্যনাথকে যতই উৎসাহ দেন এবং ভৎসনা করেন বৈদ্যনাথ ততই কোনােদিকে রাস্তা দেখিতে পান না। কোনখানে খুঁড়িতে আরম্ভ পারেন না । । মোক্ষদা নিতান্ত বিরক্ত হইয়া স্বামীকে জানাইলেন যে, পুরুষমানুষের মাথায় যে মস্তিষ্কের পরিবর্তে এতটা গোময় থাকিতে পারে, তাহা তঁহার পূর্বে ধারণা ছিল না। বলিলেন, “একটু নড়িয়াচড়িয়া দেখো। ই করিয়া বসিয়া থাকিলে কি আকাশ হইতে টাকা বৃষ্টি হইবে।” কথাটা সংগত বটে এবং বৈদ্যনাথের একান্ত ইচ্ছাও তাই, কিন্তু কোন দিকে নড়িবেন, কিসের উপর চড়িবেন, তাহা যে কেহ বলিয়া দেয় না। অতএব দাওয়ায় বসিয়া বৈদ্যনাথ আবার ছড়ি চাচিতে লাগিলেন । এদিকে আশ্বিন মাসে দুর্গোৎসব নিকটবতী হইল - চতুর্থর দিন হইতেই ঘাটে নীেকা আসিয়া লাগিতে লাগিল। প্রবাসীরা দেশে ফিরিয়া আসিতেছে। বুড়িতে মানকচু, কুমড়া, শুষ্ক নারিকেল, টিনের বাক্সের মধ্যে ছেলেদের জন্য জুতা ছাতা কাপড় এবং প্রেয়সীর জন্য এসেন্স সাবান নূতন গল্পের বহি এবং সুবাসিত । নারিকেলতৈল । মেঘমুক্ত আকাশে শরতের সূর্যকিরণ উৎসবের হাস্যের মতো ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়ছে, পঙ্কপ্রায় ধান্যক্ষেত্র থর থর করিয়া কঁাপিতেছে, বর্ষাধীেত সতেজ তরুপল্লব নব শীতবায়ুতে সিরাসির করিয়া উঠিতেছে- এবং তসরের চায়নাকোট পরিয়া কাধে একটি পাকানো চাদর বুলাইয়া ছাতি মাথায় প্রত্যাগত পথিকেরা মাঠের পথ দিয়া ঘরের মুখে চলিয়াছে। বৈদ্যনাথ বসিয়া বসিয়া তাই দেখেন এবং তঁহার হৃদয় হইতে দীর্ঘনিশ্বাস উচ্ছসিত হইয়া উঠে। নিজের - নিরানন্দ গৃহের সহিত বাংলাদেশের সহস্র গৃহের মিলনোৎসবের তুলনা করেন এবং মনে মনে বলেন, “বিধাতা কেন আমাকে এমন অকৰ্মণ্য করিয়া সৃজন করিয়াছেন।” ছেলেরা ভোরে উঠিয়াই প্রতিমা নির্মাণ দেখিবার জন্য আদ্যানাথের বাড়ির প্রাঙ্গণে গিয়া হাজির হইয়াছিল। খাবার বেলা হইলে দাসী তাহাদিগকে বলপূর্বক গ্রেফতার করিয়া লইয়া আসিল। তখন বৈদ্যনাথ বসিয়া বসিয়া এই বিশ্বব্যাপী উৎসবের মধ্যে নিজের জীবনের নিস্ফলতা স্মরণ করিতেছিলেন। দাসীর হাত অবু, এবার পুজোর সময় কী চাস বল দেখি।”