পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VVS রবীন্দ্র-রচনাবলী আত্মসমর্পণ করিল, তখন বেশ বুঝিতে পরিলাম পাখিদের মধ্যে রসিক লেখকের দল নাই, এবং সুরুচি লইয়া তর্ক হয় না । মনের মধ্যে কেবলই ভাবিতেছি কী উত্তর দেওয়া যায়। ভদ্রতার একটা বিশেষ অসুবিধা এই যে, সকল স্থানের লোকে তাহাকে বুঝিতে পারে না। অভদ্রতার ভাষা অপেক্ষাকৃত পরিচিত, তাই ভাবিতেছিলাম সেইরকম ভাবের একটা মুখের মতো জবাব লিখিতে হইবে। কিছুতেই হার মানিতে পারিব না। এমন সময় সেই সন্ধ্যার অন্ধকারে একটি পরিচিত ক্ষুদ্র কণ্ঠের স্বর শুনিতে পাইলাম এবং তাহার পরেই আমার করতলে একটি কোমল উষ্ণ স্পর্শ অনুভব করিলাম। এত উদবেজিত অন্যমনস্ক ছিলাম যে, সেই মুহুর্তে সেই স্বর ও সেই স্পর্শ জানিয়াও জানিতে পারিলাম না। : কিন্তু এক মুহূর্ত পরেই সেই স্বর ধীরে ধীরে আমার কর্ণেজাগ্ৰত, সেই সুধাস্পৰ্শ আমার করতলে সঞ্জীবিত হইয়া উঠিল। বালিকা একবার আস্তে আস্তে কাছে আসিয়া মৃদুস্বরে ডাকিয়াছিল, “বাবা” । কোনো উত্তর না পাইয়া আমার দক্ষিণ হস্ত তুলিয়া ধরিয়া একবার আপনার কোমল কপােলে বুলাইয়া আবার ধীরে ধীরে গৃহে বহুদিন প্রভা আমাকে এমন করিয়া ডাকে নাই এবং স্বেচ্ছাক্রমে আসিয়া আমাকে এতটুকু আদর করে নাই। তাই আজ সেই স্নেহম্পর্শে আমার হৃদয় সহসা অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিল। কিছুক্ষণ পরে ঘরে ফিরিয়া গিয়া দেখিলাম প্রভাবিছানায় শুইয়া আছে। শরীর ক্লিষ্টচ্ছবি, নয়ন ঈষৎ নিমীলিত ; দিনশেষের ঝরিয়া-পড়া ফুলের মতো পড়িয়া আছে। א মাথায় হাত দিয়া দেখি অত্যন্ত উষ্ণ ; উত্তপ্ত নিশ্বাস পড়িতেছে ; কপালের শির দপদপ করিতেছে। বুঝিতে পারিলাম, বালিকা আসন্ন রোগের তাপে কাতর হইয়া পিপাসিত হৃদয়ে একবার পিতার স্নেহ পিতার আদর লাইতে গিয়াছিল, পিতা তখন জাহিরপ্রকাশের জন্য খুব একটা কড়া জবাব কল্পনা করিতেছিল। পাশে আসিয়া বসিলাম । বালিকা কোনো কথা না বলিয়া তাহার দুই জ্বরতপ্ত করতলের মধ্যে আমার হস্ত টানিয়া লইয়া তাহার উপরে কপোল রাখিয়া চুপ করিয়া শুইয়া রহিল। জাহিরগ্রাম এবং আহিরগ্রামের যত,কাগজ ছিল সমস্ত পুড়াইয়া ফেলিলাম। কোনো জবাব লেখা হইল না। হার মানিয়া এত সুখ কখনাে হয় নাই। । বালিকার যখন মাতা মরিয়াছিল তখন তাহাকে কোলে টানিয়া লইয়াছিলাম, আজ তাহার বিমাতার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাপন করিয়া আবার তাহাকে বুকে তুলিয়া লইয়া ঘরে চলিয়া গেলাম। বৈশাখ ১৩০০ মধ্যবর্তিনী প্রথম পরিচ্ছেদ নিবারণের সংসার নিতান্তই সচরাচর রকমের, তাহাতে কাব্যরসের কোনো নামগন্ধ ছিল না। জীবনে উক্ত রসের যে কোনাে আবশ্যক আছে, এমন কথা তাহার মনে কখনাে উদয় হয় নাই। যেমন পরিচিত পুরাতন চট-জোড়াটার মধ্যে পা দুটাে দিব্য নিশ্চিন্তভাবে প্রবেশ করে, এই পুরাতন পৃথিবীটার মধ্যে নিবারণ সেইরূপ আপনার চিরাভ্যন্ত স্থানটি অধিকার করিয়া থাকে, সে সম্বন্ধে ভ্ৰমেও কোনোরূপ চিন্তা তর্ক বা তত্ত্বালোচনা করে না । নিবারণ প্ৰাতঃকালে উঠিয়া গলির ধারে গৃহদ্বারে খােলা গায়ে বসিয়া অত্যন্ত নিরুদবিগ্নভাবে ছকটি লইয়া তামাক খাইতে থাকে। পথ দিয়া লোকজন যাতায়াত করে, গাড়িঘোড়া চলে, বৈষ্ণব-ভিখারী গান গাহে,