পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8Y N রবীন্দ্র-রচনাবলী এই স্মৃতিচিত্রগুলিও সেইরূপ সাহিত্যের সামগ্ৰী। ইহাকে জীবনবৃত্তান্ত লিখিবার চেষ্টা হিসাবে গণ্য করিলে ভুল করা হইবে। সে হিসাবে এ লেখা নিতান্ত অসম্পূর্ণ এবং অনাবশ্যক। শিক্ষারম্ভ আমরা তিনটি বালক” একসঙ্গে মানুষ হইতেছিলাম। আমার সঙ্গীদুটি আমার চেয়ে দুই বছরের বড়ো । র্তাহারা যখন গুরুমহাশয়ের কাছে পড়া আরম্ভ করিলেন আমারও শিক্ষা সেই সময়ে শুরু হইল, কিন্তু সে-কথা আমার মনেও নাই । কেবল মনে পড়ে, জল পড়ে পাতা নড়ে।” তখন 'কর, খলা প্রভৃতি বানানের তুফান কাটাইয়া সবেমাত্র কুল পাইয়াছি। সেদিন পড়তেছি, জল পড়ে পাতা নড়ে।” আমার জীবনে এইটেই আদিকবির প্রথম কবিতা । সেদিনের আনন্দ আজও যখন মনে পড়ে তখন বুঝিতে পারি, কবিতার মধ্যে মিল জিনিসটার এত প্রয়োজন কেন । মিল আছে বলিয়াই কথাটা শেষ হইয়াও শেষ হয় না- তাহার বক্তব্য যখন ফুরায় তখনো তাহার ঝংকারটা ফুরায় না-মিলটাকে লইয়া কানের সঙ্গে মনের সঙ্গে খেলা চলিতে থাকে। এমনি করিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া সেদিন আমার সমস্ত চৈতন্যের মধ্যে জল পড়িতে ও পাতা নড়িতে লাগিল । এই শিশুকালের আর-একটা কথা মনের মধ্যে বাধা পড়িয়া গেছে। আমাদের একটি অনেক কালের খাজাঞ্চি ছিল,কৈলাস মুখুজ্যে তাহার নাম। সে আমাদের ঘরের আত্মীয়েরই মতো। লোকটি ভারি রসিক । সকলের সঙ্গেই তাহার হাসিতামাশা। বাড়িতে নূতনসমাগত জামােতাদিগকে সে বিদ্যুপে কৌতুকে বিপন্ন করিয়া তুলিত। মৃত্যুর পরেও তাহার কীেতুকপরতা কমে নাই, এরূপ জনশ্রুতি আছে। একসময়ে আমার গুরুজনেরা প্ল্যাঞ্চেটী-যোগে পরলোকের সহিত ডাক বসাইবার চেষ্টায় প্রবৃত্ত ছিলেন। একদিন তঁহাদের প্ল্যাঞ্চোেটর পেন্সিলের রেখায় কৈলাস মুখুজ্যের নাম দেখা দিল। তাহাকে জিজ্ঞাসা করা হইল, তুমি যেখানে আছ সেখানকার ব্যবস্থােটা কিরূপ, বলে দেখি । উত্তর আসিল, আমি মরিয়া যাহা জানিয়াছি, আপনারা বাচিয়াই তাঁহা ফাকি দিয়া জানিতে চান ? সেটি হইবে না। সেইকৈলাস মুখুজ্যে আমার শিশুকালে অতি দ্রুতবেগে মন্ত একটা ছড়ার মতো বলিয়া আমার মনােরঞ্জন করিত। সেই ছড়াটার প্রধান নায়ক ছিলাম আমি এবং তাহার মধ্যে একটি ভাবী নায়িকার নিঃসংশয় সমাগমের আশা আতিশয় উজ্জ্বলভাবে বর্ণিত ছিল। এই যে ভুবনমোহিনী বধুটি ভবিতব্যতার কোল আলো করিয়া বিরাজ করিতেছিল, ছড়া শুনিতে শুনিতে তাহার চিত্রটিতে মন ভারি উৎসুক হইয়া উঠিত। আপাদমস্তক তাহার যে বহুমূল্য অলংকারের তালিকা পাওয়া গিয়াছিল এবং মিলনােৎসবের যে অভূতপূর্ব সমারোহের বর্ণনা শুনা যাইত, তাহাতে অনেক প্রবীণবয়স্ক সুবিবেচক ব্যক্তির মন চঞ্চল হইতে পারিতকিন্তু বালকের মন যে মাতিয়া উঠিত এবং চোখের সামনে নানাবর্ণে বিচিত্র আশ্চর্য সুখচ্ছবি দেখিতে পাইত, তাহার মূল কারণ ছিল সেই দ্রুত উচ্চারিত অনর্গল শব্দচ্ছটা এবং ছন্দের দােলা। শিশুকালের সাহিত্যরসভোগের এই দুটাে স্মৃতি এখনাে জাগিয়া আছে- আর মনে পড়ে, ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান।” ঐ ছড়াটা যেন শৈশবের মেঘদূত । তাহার পরে যে কথাটা মনে পড়িতেছে তাহা ইস্কুলে যাওয়ার সূচনা। একদিন দেখিলাম, দাদা এবং আমার বয়োজ্যেষ্ঠ ভাগিনেয় সত্য ইস্কুলে গেলেন, কিন্তু আমি ইস্কুলে যাইবার যোগ্য বলিয়া গণ্য হইলাম না। উচ্চৈঃস্বরে কান্না ছাড়া যোগ্যতা প্রচার করার আর-কোনো উপায় আমার হাতে ছিল না। ইহার পূর্বে ১ “আমার দাদা সোমেন্দ্রনাথ, আমার ভাগিনেয় সত্যপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়]] এবং আমি।”— পাণ্ডুলিপি ২ মাধবচন্দ্ৰ মুখোপাধ্যায়। --র-কথা ৩। বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপের পাঠশালায়- ছেলেবেলা, অধ্যায় ৮ ৪ দ্ৰ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর -প্ৰশীত বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ