পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

《a8 রবীন্দ্র-রচনাবলী মানুষের হৃদয় তাহার দ্বারা প্ৰতিহত হয় না। রাজেন্দ্যানেরসিংহদ্বারটা কেমন ? তাহা যতই অভ্ৰভেদী হােক, তাহার কারুনৈপূণ্য যতই থােক, তবু সে বলে না। আমাতে আসিয়াই সমস্ত পথ শেষ হইল। আসল গন্তব্য স্থানটি যে তাহাকে অতিক্রম কক্লিয়াই আছে। এই কথাই তাহার জানাইবার কথা। এইজন্য সেই তোরণা কঠিন পাথর দিয়া যত দৃঢ় করিয়াই তৈরি হউক না কেন, সে আপনার মধ্যে অনেকখানিফাক রাখিয়া দেয়। বস্তুত সেই ফাকটাকেই প্রকাশ করিবার জন্য সে খাড়া হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। সে যতটা আছে তাহার চেয়ে নাই অনেক বেশি। তাহার সেই নাই অংশটাকে যদি সে একেবারে ভরাট করিয়া দেয়। তবে সিংহোদ্যানের পথ একেবারেই বন্ধ। তবে তাহার মতো নিষ্ঠুর বাধা আর নাই। তবে সে দেয়াল হইয়া উঠে এবং যাহারা মূঢ় তাহারা মনে করে। এইটেই দেখিবার জিনিস, ইহর পশ্চাতে আর কিছুই নাই ; এবং যাহারা সন্ধান জানে তাহারা ইহাকে অতি স্কুল একটা মূর্তিমান বাহুল্য জানিয়া অন্যত্র পথ খুঁজতে বাহির হয়। রূপমাত্রই এইরূপ সিংহদ্বার। সে আপনার ফাকটা লইয়াই গৌরব করিতে পারে। সে আপনাকেই নির্দেশ করিলে বঞ্চন করে, পথ নির্দেশ করিলেই সত্য কথা বলে। সে ভূমীকে দেখাইবে, আনন্দকে প্রকাশ করিবে, কী শিল্প-সাহিত্যেকী জগৎ সৃষ্টিতে এই তাহার একমাত্র কাজ। কিন্তু সে প্রায় মাঝে মাঝে দূরাকাঙক্ষাগ্ৰস্ত দাসের মতো আপনার প্রভুর সিংহাসনে চড়িয়া বসিবার আয়োজন করে। তখন তাহার সেই স্পর্ধায় আমরা যদি যোগ দিই। তবে বিপদ ঘটে- তখন তাহাকে নষ্ট করিয়া ফেলাই তাহার সম্বন্ধে আমাদের কর্তব্য- তা সে যতই প্রিয় হােক, এমনকি, সে যদি আমার নিজেরই অহংরািপটা হয় তবুও । বস্তুত রূপ যাহা তাহাকে তাহার চেয়ে বড়ো করিয়া জানিলেই সেই বড়োকে হারানো হয়। মানুষের সাহিত্য শিল্পকলায় হৃদয়ের ভাব রূপে ধরা দেয় বটে কিন্তু রূপে বদ্ধ হয় না। এইজন্য সে কেবলই নব নব রূপের প্রবাহ সৃষ্টি করিতে থাকে। তাই প্রতিভাকে বলে নবনবােন্মেষশালিনী বুদ্ধি । প্রতিভা রূপের মধ্যে চিত্তকে ব্যক্ত করে। কিন্তু বন্দী করে না- এইজন্য নব নব উন্মেষের শক্তি তাহার থাকা bie মনে করা যাক পূর্ণিমা রাত্রির শুভ্র সৌন্দর্য দেখিয়া কোনাে কবি বর্ণনা করিতেছেন যে, সুরলোকে নীলকান্তমণিময় প্রাঙ্গণে সূরাঙ্গনারা নন্দনের নবমল্লিকায় ফুলশয্যা রচনা করিতেছেন। এই বর্ণনা যখন আমরা পড়ি তখন আমরা জানি পূর্ণিমা রাত্রিসম্বন্ধে এই কথাটা একেবারে শেষ কথা নহে- অসংখ্য ব্যক্ত ও অব্যক্ত কথার মধ্যে এ একটা কথা- এই উপমাটিকে গ্ৰহণ করার দ্বারা অন্য অগণ্য উপমার পথ বন্ধ করা হয় না, বরঞ্চ পথকে প্রশান্তই করা হয়। কিন্তু যদি আলংকারিক বলপূর্বক নিয়ম করিয়া দেন যে, পূর্ণিমা রাত্রিসম্বন্ধে সমস্ত মানবসাহিত্যে এই একটিমাত্র উপমা ছাড়া আর কোনো উপমাই হইতে পারে না-যদি কেহ বলে, কোনাে দেবতা রাত্রে স্বপ্ন দিয়াছেন যে এই রূপই পূর্ণিমার সত্য রূপ- এইরূপকেই কেবল ধ্যান করিতে হইবে, প্রকাশ করিতে হইবে, কাব্যে পুরাণে এইরূপেরই আলোচনা করিতে হইবে, তবে পূর্ণিমা সম্বন্ধে সাহিত্যের দ্বার রুদ্ধ হইয়া যাইবে। তবে আমাদিগকে স্বীকার করিতে হইবে এরূপ চরম উপমার দৌরাত্ম্য একেবারে অসহ- কারণ ইহা মিথ্যা। যতক্ষণ ইহা চরম ছিল না ততক্ষশই ইহা সত্য ছিল। বস্তুত এই কথাটাই সত্য যে পূর্ণিমা সম্বন্ধে নিত্য নব নব রূপে মানুষের আনন্দ আপনাকেই প্রকাশ করে। কোনো বিশেষ একটিমাত্র রূপই যদি সত্য হয় তবে সেই আনন্দই মিথ্যা হইয়া যায়। জগৎ সৃষ্টিতেও যেমন সৃষ্টিকর্তর আনন্দ কোনো একটিমাত্র রূপে আপনাকে চিরকাল বদ্ধ করিয়া শেষ করিয়া ফেলে নাই- অনাদিকাল হইতে তাহার নব নব বিকাশ চলিয়া চিরকালের মতো বন্দী করিয়া থামিয়া যায় নাই, সে কেবলই নব নব প্রকাশের মধ্যে লীলা করিতেছে। কারণ, রূপ জিনিসটা কোনোকালে বলিতে পরিবে না যে, আমি এইখনেই থামিয়া দাড়াইলাম, আমিই শেষ- সে যদি চলিতে না পারে তবে তাহকে বিকৃত হইয়া মরিতে হইবে। বাতি যেমন ছাই হইতে হইতে শিখাকে প্রকাশ করে, রূপ তেমনি কেবলই আপনাকে লোপ করিতে করিতে একটি শক্তিকে আনন্দকে প্রকাশ করিতে থাকে। বাতি যদি নিজে অক্ষয় হইতে চায়। তবে শিখকেই গােপন করে- রূপ যদি আপনাকেই ধুৰ করিতে চায়। তবে সত্যকে অস্বীকার করা ছাড়া তাহার উপায় নাই। এইজন্য রূপের