পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিচয় । VSA) করিয়া তুলিবে । আমরা নিজেকে পাইবার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্তকে পাইবার আকাঙক্ষা করিব। আজ সমস্ত পৃথিবীতেই একদিকে যেমন দেখিতেছি প্রত্যেক জাতিই নিজের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য প্রাণপণ করিতেছে, কোনোমতেই অন্য জাতির সঙ্গে বিলীন হইতে চাহিতেছে না, তেমনি দেখিতেছি প্রত্যেক জাতিই বৃহৎ মানবসমাজের সঙ্গে আপনার যোগ অনুভব করিতেছে। সেই অনুভূতির বলে সকল জাতিই আজ নিজেদের সেই সকল বিকট বিশেষত্ব বিসর্জন দিতেছে — যাহা অসংগত অদ্ভূতরূপে তাহার একান্ত নিজের- যাহা সমস্ত মানুষের বুদ্ধিকে রুচিকে ধর্মকে আঘাত করে- যাহা কারাগারের প্রাচীরের মতো, বিশ্বের দিকে যাহার বাহির হইবার বা প্রবেশ করিবার কোনােপ্রকার পথই নাই। আজ প্রত্যেক জাতিই তাহার নিজের সমস্ত সম্পদকে বিশ্বের বাজারে যাচাই করিবার জন্য আনিতেছে। তাহার নিজত্বকে কেবল তাহার নিজের কাছে চোখ বুজিয়া বড়ো করিয়া তুলিয়া তাহার কোনো তৃপ্তি নাই, তাহার নিজত্বকে কেবল নিজের ঘরে ঢাক পিটাইয়া ঘোষণা করিয়া তাহার কোনো গৌরব নাই- তাহার নিজত্বকে সমস্ত জগতের অলংকার করিয়া তুলিবে তাহার অন্তরের মধ্যে এই প্রেরণা আসিয়াছে। আজ যে দিন আসিয়াছে, আজ আমরা কেহই গ্ৰাম্যতাকেই জাতীয়তা বলিয়া অহংকার করিতে পারিব না । আমাদের যে-সকল আচার ব্যবহার সংস্কার আমাদিগকে ক্ষুদ্র করিয়া পৃথক করিয়াছে, যে-সকল থাকাতে কেবলই আমাদের সকল দিকে বাধাই বাড়িয়া উঠিয়াছে, ভ্ৰমণে বাধা, গ্রহণে বাধা, দানে বাধা, চিন্তায় বাধা, কর্মেবাধ- সেই সমস্ত কৃত্রিম বিঘ্ন ব্যাঘাতকে দূর করিতেই হইবে- নহিলে মানবের রাজধানীতে আমাদের লাঞ্ছনার সীমা থাকিবে না। এ কথা আমরা মুখে স্বীকার করি আর না করি, অন্তরের মধ্যে ইহা আমরা বুঝিয়েছি। আমাদের সেই জিনিসকেই আমরা নানা উপায়ে খুঁজিতেছি, যাহা বিশ্বের আদরের ধন যাহা কেবলমাত্র ঘরগড়া আচার-অনুষ্ঠান নহে। সেইটেকেই লাভ করিলেই আমরা যথার্থভাবে রক্ষা পাইব- কারণ, তখন সমস্ত জগৎ নিজের গরজে আমাদিগকে রক্ষা করিবে । এই ইচ্ছা আমাদের অন্তরের মধ্যে জাগিয়া উঠিয়াছে বলিয়াই আমরা আর কোণে বসিয়া থাকিতে পারিতেছি না। আজ আমরা যে-সকল প্রতিষ্ঠানের পত্তন করিতেছি, তাহার মধ্যে একই কালে আমাদের স্বাতন্ত্র্যবােধ এবং বিশ্ববােধ দুই প্রকাশ পাইতেছে। নতুবা আর পঞ্চাশ বৎসর পূর্বে হিন্দু-বিশ্ববিদ্যালয়ের কল্পনাও আমাদের কাছে নিতান্ত অদ্ভুত বােধ হইত। এখনাে একদল লোক আছেন যাহাঁদের কাছে ইহার অসংগতি পীড়াজনক বলিয়া ঠেকে। তাহারা এই মনে করিয়া গীেরব বোধ করেন যে হিন্দু এবং বিশ্বের মধ্যে বিরোধ আছে- তাই হিন্দু নানাপ্রকারে আটঘটি বাঁধিয়া অহােরাত্র বিশ্বের সংস্রব ঠেকাইয়া রাখিতেই চায় ; অতএব হিন্দু টােল হইতে পারে, হিন্দু চতুস্পষ্ঠী হইতে পারে, কিন্তু হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় হইতেই পারে না- তাহা সোনার পাথরবাটি। কিন্তু এই দল যে কেবল কমিয়া আসিতেছে তাহা নহে, ইহাদেরও নিজেদের ঘরের আচরণ দেখিলে বোঝা যায় ইহারা যে কথাকে বিশ্বাস করিতেছেন বলিয়া বিশ্বাস করেন, গভীরভাবে, এমন-কি, নিজের অগোচরে তাহাকে বিশ্বাস করেন না। যেমন করিয়াই হউক আমাদের দেশের মর্মাধিষ্ঠাত্রী দেবতাকে আমরা চিরকাল মন্দিরের অন্ধকার কোণে বসাইয়া রাখিতে পারিব না। আজ রথযাত্রার দিন আসিয়াছে’- বিশ্বের রাজপথে, মানুষের সুখদুঃখ ও আদান-প্রদানের পণ্যবীথিকায় তিনি বাহির হইয়াছেন। আজ আমরা তাহার রথ নিজেদের সাধ্য অনুসারে যে যেমন করিয়াই তৈরি করি।-না- কেহ বা বেশি মূল্যের উপাদান দিয়া, কেহ বা অল্প মূল্যের- চলিতে চলিতে কাহারও বা রথ পথের মধ্যেই ভাঙিয়া পড়ে, কাহারও বা বৎসরের পর বৎসর টিকিয়া থাকে- কিন্তু আসল কথাটা এই যে শুভলগ্নে রথের সময় আসিয়াছে। কোন রথ কোন পর্যন্ত গিয়া পীে ছিবে তাহা আগে থাকিতে হিসাব করিয়া বলিতে পারি না- কিন্তু আমাদের বড়েদিন আসিয়াছে- আমাদের সকলের চেয়ে যাহা মূল্যবান পদার্থ তাহা আজ আর কেবলমাত্র পুরোহিতের বিধি-নিষেধের আড়ালে ধূপ-দীপের ঘনঘোর বাম্পের মধ্যে গোপন থাকিবে না- আজ বিশ্বের আলোকে আমাদের যিনি বরেণ্য তিনি বিশ্বের বরেণ্যরূপে সকলের কাছে গোচর হইবেন । তাঁহারই একটি রথ নির্মাণের কথা আজ আলোচনা করিয়াছি; ইহার পরিণাম কী তাহা নিশ্চয় জানি না, কিন্তু ইহার মধ্যে সকলের চেয়ে আনন্দের কথা এই যে, এই রথ বিশ্বের পথে চলিয়াছে, প্রকাশের পথে বাহির হইয়াছে, সেই আনন্দের আবেগেই আমরা সকলে মিলিয়া জয়ধ্বনি