পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8२० রবীন্দ্র-রচনাবলী হইয়া থাকিবে এবং তাহার জীবনে অনেক গুরুতর সুখদুঃখলজ্জার দিন আসিয়াছে সন্দেহ নাই, কিন্তু সেইদিনকার বালকহৃদয়ের ইতিহাসের সহিত কোনোদিনের তুলন হইতে পারে না । কিন্তু ব্যাপারটা অতি ক্ষুদ্র এবং দুই কথায় শেষ হইয়া যায়। আশুর একটি ছোটো বোন আছে ; তাহার সমবয়স্ক সঙ্গিনী কিংবা ভগিনী আরকেহ নাই, সুতরাং আশুর সঙ্গেই তাহার যত খেলা। একটি গেটওয়ালা লোহার রেলিঙের মধ্যে আশুদের বাড়ির গাড়িবারান্দা। সেদিন মেঘ করিয়া খুব বৃষ্টি হইতেছিল। জুতা হাতে করিয়া, ছাতা মাথায় দিয়া যে দুইচারিজন পথিক পথ দিয়া চলিতেছিল, তাহদের কোনো দিকে চাহিবার অবসর ছিল না। সেই মেঘের অন্ধকারে, সেই বৃষ্টিপতনের শব্দে, সেই সমস্তদিন ছুটিতে, গাড়িবারান্দার সিড়িতে বসিয়া আশু তাহার বোনের সঙ্গে খেলা করিতেছিল। সেদিন তাহাদের পুতুলের বিয়ে। তাহারি আয়োজন সম্বন্ধে অত্যন্ত গম্ভীরভাবে ব্যস্ত হইয়া আশু তাহার ভগিনীকে উপদেশ দিতেছিল। এখন তর্ক উঠিল, কাহাকে পুরোহিত করা যায়। বালিকা চট করিয়া ছুটিয়া একজনকে গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ই গা, তুমি আমাদের পুরুতষ্ঠাকুর হবে ?” আশু পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখে, শিবনাথপণ্ডিত ভিজ ছাতা মুড়িয়া অৰ্ধসিক্ত অবস্থায় তাহাদের গাড়িবারান্দায় দাড়াইয়া আছেন ; পথ দিয়া যাইতেছিলেন, বৃষ্টির উপদ্রব হইতে সেখানে আশ্রয় লইয়াছেন। বালিকা তাহাকে পুতুলের পৌরোহিত্যে নিয়োগ করিবার প্রস্তাব করিতেছে । পণ্ডিতমশায়কে দেখিয়াই আশু তাহার খেলা এবং ভগিনী সমস্ত ফেলিয়া একদৌড়ে গৃহের মধ্যে অন্তহিত হইল। তাহার ছুটির দিন সম্পূর্ণ মাটি হইয়া গেল। পরদিন শিবনাথপণ্ডিত যখন শুষ্ক উপহাসের সহিত এই ঘটনাটি ভূমিকাস্বরূপে উল্লেখ করিয়া সাধারণসমক্ষে আশুর ‘গিন্নি’ নামকরণ করিলেন, তখন প্রথমে সে যেমন সকল কথাতেই মৃদুভাবে হাসিয়া থাকে তেমন করিয়া হাসিয়া চারিদিকের কৌতুকহাস্তে ঈষৎ যোগ দিতে চেষ্টা করিল ; এমনসময় একটা ঘণ্টা বাজিল, অন্য-সকল ক্লাস ভাঙিয়া গেল, এবং শালপাতায় দুটি মিষ্টান্ন ও ঝকঝকে র্কাসার ঘটিতে জল লইয়া দাসী আসিয়া দ্বারের কাছে দাড়াইল । * তখন হাসিতে হাসিতে তাহার মুখকান টকটকে লাল হইয়া উঠিল, ব্যথিত কপালের শিরা ফুলিয়া উঠিল, এবং উচ্ছসিত অশ্রজল আর কিছুতেই বাধা মানিল না। শিবনাথপণ্ডিত বিশ্রামগৃহে জলযোগ করিয়া নিশ্চিন্তমনে তামাক খাইতে লাগিলেন