পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী একটি কবির দিকে চাহিয়ে না। যদি চাও তো বলিবে “এ কী হইল! এ তো যথেষ্ট হইল না! এ দেশে কি তবে এই কবিতা?” বিরক্ত হইয়া হয়তো প্ৰাচীন সাহিত্য অন্বেষণ করিতে যাইবে। যদি মহাভারত কি রামায়ণ কি গ্ৰীসীয় একটা কোনো মহাকাব্য নজরে পড়ে, তবে বলিবে, “পর্যাপ্ত হইয়াছে! প্রচুর হইয়াছে!” এক মহাভারত বা এক রামায়ণ পড়িলেই তুমি প্রাচীন সাহিত্যের সমস্ত ভাবটি পাইলে। কিন্তু এখন সেদিন গিয়াছে। এখন একখানা কবিতার বইকে আলাদা করিয়া পড়িলে পাঠের অসম্পূর্ণতা থাকিয়া যায়। মনে করে ইংলন্ড। ইংলন্ডে যত কবি আছে সকলকে মিলাইয়া লইয়া এক বলিয়া ধরিতে হইবে। ইংলন্ডে যে কবিতা-পাঠক-শ্রেণী আছেন, তাহদের হৃদয়ের এক-একটা মহাকাব্য রচিত হইতেছে। তাহারা বিভিন্ন কবির বিভিন্ন কাব্যগুলি মনের মধ্যে একত্রে বাধাইয়া রাখিতেছেন। ইংলন্ডের সাহিত্যে মানবহৃদয়-নামক একটা বিশাল মহাকাব্য রচিত হইতেছে, অনেকদিন হইতে অনেক কবি তাহার একটু একটু করিয়া লিখিয়া আসিতেছেন। পাঠকেরাই এই মহাকাব্যের বেদব্যাস। তাহারা মনের মধ্যে সংগ্ৰহ করিয়া সন্নিবেশ করিয়া তাহাকে একত্রে পরিণত করিতেছেন। যে কেহ ইহার একটি মাত্র অংশ দেখেন অথবা সকল অংশগুলিকে আলাদা করিয়া দেখেন, তিনি নিতান্ত ভ্ৰমে পড়েন। তিনি বলেন, সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে কাব্য অগ্রসর হইতেছে না। তিনি কী করেন, না, একটি সাধারণতন্ত্রের শাসনপ্রণালীর প্রতিনিধিগণের প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করিয়া দেখেন। দেখেন রাজার মতো প্ৰভূত ক্ষমতা কাহারও হস্তে নাই, রাজার মতো একাধিপত্য কেহ করিতে পায় না, ও তৎক্ষণাৎ এই সিদ্ধান্ত করিয়া বসেন যে, “দেশের রাজ্যপ্ৰণালী ক্রমশই অবনত হইয়া আসিতেছে। সভ্যতা বাড়িতেছে বটে কিন্তু রাজতন্ত্রের উন্নতি কিছুই দেখিতে পাইতেছি না। বরঞ্চ উল্টা!” কিন্তু সভ্যতা বাড়িতেছে বলিলেই বুঝায় যে, জ্ঞানও বাড়িতেছে, কবিতাও বাড়িতেছে। রাজতন্ত্র যখন খুব জটিল ও বিস্তৃত হয়, তখন সাধারণতন্ত্রের বিশেষ আবশ্যকতা বাড়ে। যত দিন ছোটােখাটাে সোজাসুজি রকম থাকে তত দিন সাধারণতন্ত্রের ন্যায় অতবড়ো বিস্তুত রাজ্যপ্ৰণালীর তেমন আবশ্যকতা থাকে না। এক রাজায় আর যখন চলে না। তখন সে রাজার দিন ফুরায়। যুরোপে সূক্ষ্মতম অনুভব, জটিলতম অনুভব হইতে অতি বিশদতম অনুভব-সকল কবিতার মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছে। এখনকার কবিতায় এমন-সকল ছায়াশরীরী মৃদুস্পর্শ কল্পনা খেলায় যাহা পুরাতন লোকদের মনেই আসিত না ও সাধারণ লোকেরা ধরিতে ছুইতে পারে না- এমন-সকল গঢ়তম তত্ত্ব কবিতায় নিহিত থাকে যাহা সাধারণত সকলে কবিতার অতীত বলিয়া মনে করে। প্রাচীন কালে কবিতায় কেবল নলিনী মালতী মল্লিকা যুঁথি জাতি প্রভৃতি কতকগুলি বাগানের ফুল ফুটিত, আর কোনো ফুলকে যেন কেহ কবিতার উপযুক্ত বলিয়াই মনে করিত না; আজকাল কবিতায় অতি ক্ষুদ্রকায়া , সাধারণত চক্ষুর অগোচর, তৃণের মধ্যে প্রস্ফুটিত সামান্য বনফুলটি পর্যন্ত ফুটে । এক কথায়- যাহাকে লোকে, অভ্যস্ত হইয়াছে বলিয়াই হউক বা চক্ষুর দোষেই হউক, অতি সামান্য বলিয়া দেখে বা একেবারে দেখেই না, এখনকার কবিতা তাহার অতি বৃহৎ গৃঢ়ভাব খুলিয়া দেখায়। আবার যাহাকে অতিবৃহৎ অতি-অনায়ত্ত বলিয়া লোকে ছুইতে ভয় করে, এখনকার কবিতায় তাহাকেও আয়ত্তের মধ্যে আনিয়া দেয়। অতএব এখনকার উপযোগী মহাকাব্য একজনে লিখিতে পারে না, একজনে লিখেও না। এখন শ্রমবিভাগের কাল। সভ্যতার প্রধান ভিত্তিভূমি শ্রমবিভাগ। কবিতাতেও শ্রমবিভাগ আরম্ভ হইয়াছে। শ্রমবিভাগের আবশ্যক হইয়াছে। পূর্বে একজন পণ্ডিত না জানিতেন এমন বিষয় ছিল না। লোকেরা যে বিষয়েই প্রশ্ন উত্থাপন করিত, তাহাকে সেই বিষয়েই উত্তর দিতে হইত, নহিলে আর তিনি পণ্ডিত কিসের? এক অরিস্টটল দর্শনও লিখিয়াছেন, রাজনীতিও লিখিয়াছেন, আবার ডাক্তারিও লিখিয়াছেন। তখনকার সমস্ত বিদ্যাগুলি হ-য-ব-র-ল হইয়া একত্রে ঘেঁষাৰ্ঘেষি করিয়া থাকিত। বিদ্যাগুলি একান্নাবতী পরিবারে বাস করিত, এক-একটা করিয়া পণ্ডিত তাহদের কর্তা। পরস্পরের মধ্যে চরিত্রের সহস্ৰ প্ৰভেদ থাক, এক অন্ন খাইয়া তাহারা সকলে পুষ্ট। এখন ছাড়াছাড়ি হইয়াছে, সকলেরই নিজের নিজের পরিবার হইয়াছে;