পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী 8-ל ל তাহাকেও আজ এতটা হালকা করিয়া দিল কিসে? সেও আজকাল সব সময়ে পরিহাসের সদুত্তর দিতে না পারিলে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠে। তাহার চুলে এখনো চিরুনি উঠে নাই বটে, কিন্তু তাহার চাদর আর পূর্বের মতো ময়লা নাই । তাহার দেহে মনে এখন যেন একটা চলৎশক্তির আবির্ভাব হইয়াছে। ఏ প্রণয়ীদের জন্য কাব্যে যে-সকল আয়োজনের ব্যবস্থা আছে, কলিকাতা শহরে তাহ মেলে না। কোথায় প্রফুল্ল অশোক-বকুলের বীথিক, কোথায় বিকশিত মাধবীর প্রচ্ছন্ন লতাবিতান, কোথায় চুতকষায়কণ্ঠ কোকিলের কুহুকাকলি ? তবু এই শুষ্ককঠিন সৌন্দর্যহীন আধুনিক নগরে ভালোবাসার জাদুবিদ্যা প্রতিহত হইয়া ফিরিয়া যায় না। এই গাড়িঘোড়ার বিষম ভিড়ে, এই লৌহনিগড়বদ্ধ ট্রামের রাস্তায় একটি চিরকিশোর প্রাচীন দেবতা তাহার ধনুকটি গোপন করিয়া লালপাগড়ি প্রহরীদের চক্ষের সম্মুখ দিয়া কত রাত্রে কত দিনে কত বার কত ঠিকানায় যে আনাগোনা করিতেছেন, তাহ কে বলিতে পারে। রমেশ ও হেমনলিনী চামড়ার দোকানের সামনে মুদির দোকানের পাশে কলুটোলায় ভাড়াটে বাড়িতে বাস করিতেছিল বলিয়া প্রণয়-বিকাশ সম্বন্ধে কুঞ্জকুটিরচারীদের চেয়ে তাহারা যে কিছুমাত্র পিছাইয়া ছিল, এমন কথা কেহ বলিতে পারে না। অন্নদাবাবুদের চা-রস-চিহ্নিত মলিন ক্ষুদ্র টেবিলটি পদ্মসরোবর নহে বলিয়া রমেশ কিছুমাত্র অভাব অনুভব করে নাই। হেমনলিনীর পোষা বিড়ালটি কৃষ্ণসার মৃগশাবক না হইলেও রমেশ পরিপূর্ণ স্নেহে তাহার গলা চুলকাইয়া দিত— এবং সে যখন ধনুকের মতে পিঠ ফুলাইয়া আলস্তত্যাগপূর্বক গাত্রলেহন দ্বারা প্রসাধনে রত হইত তথন রমেশের মুগ্ধদৃষ্টিতে এই প্রাণীটি গৌরবে অন্য কোনো চতুষ্পদের চেয়ে নূ্যন বলিয়। প্রতিভাত হইত না । হেমনলিনী পরীক্ষা পাস করিবার ব্যগ্রতায় সেলাইশিক্ষায় বিশেষ পটুত্ব লাভ করিতে পারে নাই, কিছুদিন হইতে তাহার এক সীবনপটু সখীর কাছে একাগ্রমনে সে সেলাই শিখিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। সেলাই ব্যাপারটাকে রমেশ অত্যন্ত অনাবশ্যক ও তুচ্ছ বলিয়া জ্ঞান করে। সাহিত্যে দর্শনে হেমনলিনীর সঙ্গে তাহার দেনাপাওনা চলে— কিন্তু সেলাই ব্যাপারে রমেশকে দূরে পড়িয়া থাকিতে হয়। এইজন্য সে প্রায়ই কিছু অধীর হইয়া বলিত, “আজকাল সেলাইয়ের কাজ কেন আপনার এত ভালো