পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

૨ ૦8 রবীন্দ্র-রচনাবলী এখন কথাটা আর কোনোমতে নরম করিয়া লইবার উপায় নাই। সবই সত্য— বিবাহ এখন স্থগিত রাখিতে হইবে, রমেশের বিশেষ প্রয়োজন আছে, কী প্রয়োজন, তাহাও সে বলিতে ইচ্ছা করে না। ইহার উপরে এখন আর নূতন ব্যাখ্যা কী হইতে পারে ? 曹 অন্নদাবাবু হেমনলিনীর দিকে চাহিয়া কহিলেন, “তোমাদেরই কাজ, এখন তোমরাই ইহার যা হয় একটা মীমাংসা করিয়া লও।” হেমনলিনী মুখ নত করিয়া বলিল, “বাবা, আমি ইহার কিছুই জানি না।” এই বলিয়া, ঝড়ের মেঘের মুখে স্বর্যাস্তের মান আভাটুকু যেমন মিলাইয়া যায়, তেমনি । করিয়া সে চলিয়া গেল । o অন্নদাবাবু খবরের কাগজ মুখের উপর তুলিয়া পড়িবার ভান করিয়া ভাবিতে লাগিলেন । রমেশ নিস্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল। হঠাৎ রমেশ একসময় চমকিয়া উঠিয়া চলিয়া গেল। বসিবার বড়ো ঘরে গিয়া দেখিল, হেমনলিনী জানালার কাছে চুপ করিয়া দাড়াইয়া আছে। তাহার দৃষ্টির সম্মুখে আসন্ন পূজার ছুটির কলিকাতা জোয়ারের নদীর মতো তাহার সমস্ত রাস্তা ও গলির মধ্যে স্ফীত জনপ্রবাহে চঞ্চল-মুখর হইয়া উঠিয়াছে। রমেশ একেবারে তাহার পার্শ্বে যাইতে কুষ্ঠিত হইল। পশ্চাং হইতে কিছুক্ষণের জন্য স্থিরদৃষ্টিতে তাহাকে দেখিতে লাগিল। শরতের অপরাঃ-আলোকে বাতায়নবর্তিনী এই স্তব্ধমূর্তিটি রমেশের মনের মধ্যে একটি চিরস্থায়ী ছবি আঁকিয়া দিল। ঐ স্বকুমার কপোলের একটি অংশ, ঐ সষত্বরচিত কবরীর ভঙ্গি, ঐ গ্রীবার উপরে কোমলবিরল কেশগুলি, তাহারই নীচে সোনার হারের একটুখানি আভাস, বাম স্কন্ধ হইতে লম্বিত অঞ্চলের বঙ্কিম প্রাস্ত, সমস্তই রেখায় রেখায় তাহার পীড়িত চিত্তের মধ্যে যেন কাটিয়া কাটিয়া বসিয়া গেল । রমেশ আস্তে আস্তে হেমনলিনীর কাছে আসিয়া দাড়াইল । হেমনলিনী রমেশের চেয়ে রাস্তার লোকদের জন্য যেন বেশি ঔৎসুক্য বোধ করিতে লাগিল । রমেশ বাপরুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “আপনার কাছে আমার একটি ভিক্ষা আছে।” of রমেশের কণ্ঠস্বরে উদ্বেল বেদনার আঘাত অনুভব করিয়া মুহূর্তের মধ্যে হেমনলিনীর মুখ ফিরিয়া আসিল। রমেশ বলিয়া উঠিল, “তুমি আমাকে অবিশ্বাস করিয়ে না।” রমেশ এই প্রথম হেমনলিনীকে ‘তুমি বলিল। “এই কথা আমাকে বলে যে, তুমি আমাকে কখনো অবিশ্বাস করিবে না। আমিও অন্তৰ্বামীকে অন্তরে সাক্ষী রাখিয়া বলিতেছি, তোমার কাছে আমি কখনো অবিশ্বাসী হইব না।”