পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি 년 8> সভাভঙ্গের পর অন্নদা হেমনলিনীকে লইয়া যখন ঘরে ফিরিলেন তখনো সন্ধ্যা হয় নাই। চা থাইতে বসিয়া অন্নদাবাবু কহিলেন, “আজ বড়ো আনন্দলাভ করিয়াছি।” ইহার অধিক আর তিনি কথা কহিলেন না ; তাহার মনের ভিতরের দিকে একটা ভাবের স্রোত বহিতেছিল। আজ চা খাওয়ার পরেই হেমনলিনী আস্তে আস্তে উপরে চলিয়া গেল, অন্নদাবাবু তাহ। লক্ষ্য করিলেন না । আজ সভাস্থলে— নলিনাক্ষ— যিনি বক্তৃতা করিয়াছিলেন, র্তাহাকে দেখিতে আশ্চর্য তরুণ এবং স্বকুমার ; যুবাবয়সেও যেন শৈশবের অমান লাবণ্য র্তাহার মুখস্ত্রকে পরিত্যাগ করে নাই ; অথচ তাহার অন্তরাত্মা হইতে যেন একটি ধ্যানপরতার গাম্ভীর্ষ র্তাহার চতুর্দিকে বিকীর্ণ হইতেছে। র্তাহার বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘ক্ষতি । তিনি বলিয়াছিলেন, সংসারে যে ব্যক্তি কিছু হারায় নাই সে কিছু পায় নাই। আমনি যাহা আমাদের হাতে আসে তাহাকে আমরা সম্পূর্ণ পাই না ; ত্যাগের দ্বারা আমরা যখন তাহাকে পাই তখনি যথার্থ তাহ আমাদের অন্তরের ধন হইয়া উঠে। যাহা-কিছু আমাদের প্রকৃত সম্পদ তাহ সম্মুখ হইতে সরিয়া গেলেই যে ব্যক্তি হারাইয়া ফেলে সে লোক দুর্ভাগা ; বরঞ্চ তাহাকে ত্যাগ করিয়াই তাহাকে বেশি করিয়া পাইবার ক্ষমতা মানবচিত্তের আছে। যাহা আমার যায় তাহার সম্বন্ধে যদি আমি নত হইয়া করজোড় করিয়া বলিতে পারি ‘আমি দিলাম, আমার ত্যাগের দান, আমার দুঃখের দান, আমার অশ্রুর দান’—- তবে ক্ষুদ্র বৃহৎ হইয়া উঠে, অনিত্য নিত্য হয় এবং যাহা আমাদের ব্যবহারের উপকরণমাত্র ছিল তাহ পূজার উপকরণ হইয়া আমাদের অন্তঃকরণের দেবমন্দিরের রত্নভাণ্ডারে চিরসঞ্চিত হইয়া থাকে। এই কথাগুলি আজ হেমনলিনীর সমস্ত হৃদয় জুড়িয়া বাজিতেছে। ছাদের উপরে নক্ষত্রদীপ্ত আকাশের তলে সে আজ স্তন্ধ হইয়া বসিল। তাহার সমস্ত মন আজ পূর্ণ; সমস্ত আকাশ, সমস্ত জগৎসংসার তাহার কাছে আজ পরিপূর্ণ। বক্তৃতাসভা হইতে ফিরিবার সময় যোগেজ কহিল, “অক্ষয়, তুমি বেশ পত্রিটি সন্ধান করিয়াছ যা হোক। এ তো সন্ন্যাসী ! এর অর্ধেক কথা তো আমি বুঝিতেই পারিলাম না।” অক্ষয় কহিল, “রোগীর অবস্থা বুঝিয়া ঔষধের ব্যবস্থা করিতে হয়। হেমনলিনী রমেশের ধ্যানে মগ্ন আছেন ; সে ধ্যান সন্ন্যাসী নহিলে আমাদের মতো সহজ লোকে