পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডুবি \రినవి করিতে পারে নাই। অথচ সমস্ত হাস্যালাপের মধ্যে নলিনাক্ষের একটা কেমন দুরত্বও ছিল। r এক দিন অন্নদাবাবু ও হেমনলিনীর সঙ্গে নলিনাক্ষের কথাবার্তা চলিতেছিল, এমন সময়ে যোগেন্দ্র কিছু উত্তেজিত হইয়া আসিয়া কহিল, “জান বাবা, আজকাল আমাদিগকে সমাজের লোকে নলিনাক্ষবাবুর চেলা বলিতে আরম্ভ করিয়াছে ? তাই লইয়া এইমাত্র পরেশের সঙ্গে আমার খুব ঝগড়া হইয়া গেছে।” অন্নদাবাবু একটু হাসিয়া বলিলেন, “ইহাতে আমি তো লজ্জার কথা কিছু দেখি না। যেখানে সকলেই গুরু, কেহই চেলা নয়, সেই দলে মিশিতেই আমার লজ্জাবোধ হয় ; সেখানে শিক্ষা দিবার হুড়োমুড়িতে শিক্ষা পাইবার অবকাশ থাকে না।” নলিনাক্ষ। অন্নদাবাবু, আমিও আপনার দলে ; আমরা চেলার দল। যেখানে আমাদের কিছু শিখিবার সম্ভাবনা আছে সেইখানেই আমরা তলপি বহিয়া বেড়াইব । যোগেন্দ্র অধীর হইয়া কহিল, “না না, কথাটা ভালো নয়। নলিনবাবু, কেহই ষে আপনার বন্ধু বা আত্মীয় হইতে পারিবে না, যাহারা আপনার কাছে আসিবে, তাহারাই আপনার চেলা বলিয়া খ্যাত হইয়া যাইবে, এমন বদনামটা হাসিয়া উড়াইয়া দিবার নহে । আপনি কী সব কাগু করেন, ওগুলা ছাড়িয়া দিন ।” নলিনাক্ষ। কী করিয়া থাকি বলুন। যোগেন্দ্র । ওই-যে শুনিয়াছি প্রাণায়াম করেন, ভোরের বেলায় স্বর্ষের দিকে তাকাইয়া থাকেন, খাওয়াদাওয়া লইয়া নানাপ্রকার আচার বিচার করিতে ছাড়েন না, ইহাতে দশের মধ্যে আপনি খাপছাড়া হইয়া পড়েন । যোগেন্দ্রের এই রূঢ়বাক্যে ব্যথিত হইয়া হেমনলিনী মাথা নিচু করিল। নলিনাক্ষ হাসিয়া কহিল, “যোগেনবাবু, দশের মধ্যে খাপছাড়া হওয়াটা দোষের। কিন্তু তলোয়ারই কী, আর মানুষই কী, তাহার সবটাই কি খাপের মধ্যে থাকে ? খাপের ভিতরে তলোয়ারের যে অংশটা থাকিতে বাধ্য সেটাতে সকল তলোয়ারেরই ঐক্য আছে— বাহিরের হাতলটাতে শিল্পীর ইচ্ছা ও নৈপুণ্য-অনুসারে কারিগরি নানা-রকমের হইয়া থাকে। মানুষেরও দশের খাপের বাহিরে নিজের বিশেষ কারিগরির একটা জায়গা আছে, সেটাও কি আপনারা বেদখল করিতে চান ? আর, আমার কাছে এও আশ্চর্য লাগে, আমি সকলের অগোচরে ঘরে বসিয়া ষে-সকল নিরীহ অনুষ্ঠান করিয়া থাকি তাহ লোকের চোখেই বা পড়ে কী করিয়া, আর তাহা লইয়া আলোচনাই বা হয় কেন ?”