পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

83२ রবীন্দ্র-রচনাবলী আমি জানিতাম না দিদি। খুড়ার বাড়িতে যখন আসিলাম তখন আমার খুড়তুতে বোন শৈলদিদির সঙ্গে আমার ভালো করিয়া পরিচয় হইল। তিনি র্তাহার স্বামীকে যেরকম করিয়া সেবা করেন তাহা চক্ষে দেখিয়া আমার প্রথম চৈতন্য জন্মিল । আমি যে-স্বামীকে কখনো দেখি নাই বলিলেই হয় আমার সমস্ত মনের ভক্তি র্তাহার উদ্দেশে যে কেমন করিয়া গেল, তাহা আমি বলিতে পারি না । ভগবান আমার সেই পূজার ফল দিয়াছেন, এখন আমার স্বামী আমার মনের সম্মুখে স্পষ্ট করিয়া জাগিয়া উঠিয়াছেন, তিনি আমাকে গ্রহণ নাই করিলেন— কিন্তু আমি তাহাকে এখন পাইয়াছি।” কমলার এই ভক্তিসিঞ্চিত কথা কয়টি শুনিয়া হেমনলিনীর অন্ত:করণ আর্দ্র হইয়া গেল। সে খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “তোমার কথা আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি। অমনি করিয়া পাওয়াই পাওয়া। আর সমস্ত পাওয়া লোভের পাওয়া, তাহা নষ্ট হইয়া যায়।” কমলা এ কথা সম্পূর্ণ বুঝিল কি না বলা যায় না ; সে হেমনলিনীর দিকে চাহিয়া রহিল, খানিক বাদে কহিল, “তুমি যাহা বলিতেছ দিদি, তা সত্যই হইবে। আমি মনে কোনো দুঃখ আসিতে দিই না, আমি ভালোই আছি ভাই। আমি যেটুকু পাইয়াছি তাই আমার লাভ।” হেমনলিনী কমলার হাত নিজের হাতে তুলিয়া লইয়া কহিল, “যখন ত্যাগ এবং লাভ একেবারে সমান হইয়া যায় তখনই তাহা যথার্থ লাভ, এই কথা আমার গুরু বলেন। সত্য বলিতেছি বোন, তোমার মতো অমনি সমস্ত নিবেদন করিয়া দিয়া যে সার্থকতা তাহাঁই যদি আমার ঘটে, তবে আমি ধন্য হইব।” কমলা কিছু বিস্মিত হইয়া কহিল, "কেন দিদি, তুমি তো সবই পাইবে, তোমার তো কোনো অভাবই থাকিবে না।” হেমনলিনী কহিল, “যেটুকু পাইবার মতো পাওয়া সেটুকু পাইয়াই যেন স্বর্থী হইতে পারি ; তার চেয়ে বেশি যতটুকুই পাওয়া যায় তার অনেক ভার, অনেক দুঃখ । আমার মুখে এ-সব কথা তোমার আশ্চর্য লাগিবে, আমার নিজেরও আশ্চর্য লাগে, কিন্তু এসব কথা ঈশ্বর আমাকে ভাবাইতেছেন। জান না বোন, আজ আমার মনে কী ভার চাপিয়া ছিল– তোমাকে পাইয়া আমার হৃদয় হালকা হইল, আমি বল পাইলাম, তাই আমি এত বকিতেছি । আমি কখনো কথা কহিতে পারি না, তুমি কেমন করিয়া আমার সব কথা টানিয়া লইতেছ ভাই ?”