পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88br রবীন্দ্র-রচনাবলী আজিকার এই মেঘোয়ুক্ত আলোকের মধ্যে আমার কাছে সেই অপরূপের মূর্তি জাগিয়াছে। সম্মুখের ওই রাস্তা, ওই খোড়ো-চাল-দেওয়া মুদির দোকান, ওই ভাঙা ভিটা, ওই সরু গলি, ওই গাছপালাগুলিকে প্রতিদিনের পরিচয়ের মধ্যে অত্যন্ত তুচ্ছ করিয়া দেখিয়াছিলাম। এইজন্য উহারা আমাকে বদ্ধ করিয়া ফেলিয়াছিল— রোজ এই কটা জিনিসের মধ্যেই নজরবন্দী করিয়া রাথিয়াছিল। আজ হঠাৎ তুচ্ছতা একেবারে চলিয়া গেছে। আজ দেখিতেছি, চির-অপরিচিতকে এতদিন পরিচিত বলিয়া দেখিতেছিলাম, ভালো করিয়া দেখিতেছিলামই না । আজ এই যাহা-কিছু সমস্তকেই দেখিয়া শেষ করিতে পারিতেছি না। আজ সেইসমস্তই আমার চারি দিকে আছে, অথচ তাহারা আমাকে আটক করিয়া রাখে নাই, তাহারা প্রত্যেকেই আমাকে পথ ছাড়িয়া দিয়াছে। আমার পাগল এইখানেই ছিলেন– সেই অপূর্ব, অপরিচিত, অপরূপ, এই মুদির দোকানের খোড়ে চালের শ্রেণীকে অবজ্ঞা করেন নাই— কেবল, যে আলোকে তাহাকে দেখা যায় সে আলোক আমার চোখের উপরে ছিল না। আজ আশ্চর্য এই যে, ওই সম্মুখের দৃশ্য, ওই কাছের জিনিস আমার কাছে একটি বহুমুদূরের মহিমা লাভ করিয়াছে। উহার সঙ্গে গৌরীশংকরের তুষারবেষ্টিত দুর্গমতা, মহাসমুদ্রের তরঙ্গচঞ্চল দুস্তরতা আপনাদের সজাতিত্ব জ্ঞাপন করিতেছে। এমনি করিয়া হঠাৎ একদিন জানিতে পারা যায়, যাহার সঙ্গে অত্যন্ত ঘরকন্না পাতাইয়া বসিয়াছিলাম সে আমার ঘরকন্নার বাহিরে। আমি যাহাকে প্রতি মুহূর্তে বাধা-বরাদ্দ বলিয়া নিতান্ত নিশ্চিস্ত হইয়াছিলাম তাহার মতো দুর্লভ দুরায়ত্ত জিনিস কিছুই নাই। আমি যাহাকে ভালোরূপ জানি মনে করিয়া তাহার চারি দিকে সীমানা আঁকিয়া দিয়া খাতির-জমা হইয়া বসিয়াছিলাম সে দেখি কখন এক মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত সীমানা পার হইয়া অপূৰ্বরহস্যময় হইয়া উঠিয়াছে। যাহাকে নিয়মের দিক দিয়া, স্থিতির দিক দিয়া, বেশ ছোটোখাটো, বেশ দস্তুর-সংগত, বেশ আপনার বলিয়াই বোধ হইয়াছিল, তাহাকে ভাঙনের দিক হইতে, ওই শ্মশানচারী পাগলের তরফ হইতে হঠাৎ দেখিতে পাইলে মুখে আর বাক্য সরে না— আশ্চর্য ও কে ! যাহাকে চিরদিন জানিয়াছি সেই, এ কে ! যে এক দিকে ঘরের সে আর-এক দিকে অস্তরের, যে এক দিকে কাজের সে আর-এক দিকে সমস্ত আবশ্বকের বাহিরে, যাহাকে এক দিকে স্পর্শ করিতেছি সে আর-এক দিকে সমস্ত আয়ত্তের অতীত— যে এক দিকে সকলের সঙ্গে বেশ খাপ খাইয়া গিয়াছে সে আর-এক দিকে ভয়ংকর খাপছাড়া, আপনাতে আপনি ।