পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

প্রাচীন সাহিত্য & 8'O কৌতুহল। এইজন্য ঘরে বাহিরে চতুর্দিকে মানুষের ক্রিয়াকলাপ জীবনবৃত্তান্ত আমরা তন্ন তন্ন করিয়া পর্যালোচনা করিয়াও পরিতৃপ্ত হই না। কিন্তু সেকালে পণ্ডিতই বল, রাজাই বল, মানুষকে বড়ো বেশি-কিছু মনে করিতেন না। বোধ করি স্থতিবিহিত নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়াক্রর্মে এবং একান্ড জনহিতভাবে শাস্ত্রাদি আলোচনায় তাহার জগৎসংসারে অনেকটা বেশি নির্লিপ্ত ছিলেন । বোধ করি বিধিবিধান-নিয়মসংযমের শাসনে ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যের বড়ো একটা প্রশ্রয় ছিল না। এইজন্য রামায়ণমহাভারতের পরবর্তী সংস্কৃত সাহিত্যে লোকচরিত্রস্থষ্টি এবং সংসারবর্ণনার প্রাধান্ত দেখা যায় না। ভাব এবং রস তাহার প্রধান অবলম্বন। রঘুর দিগ্বিজয়-ব্যাপারে অনেক উপমা এবং সরস বর্ণনা প্রকাশিত হইয়াছে, কিন্তু রঘুর বীরত্বের বিশেষ একটা চরিত্রগত চিত্র পরিস্ফুট করিবার চেষ্টা দেখা যায় না। অজ-ইন্দুমতী-ব্যাপারে অজ এবং ইন্দুমতী উপলক্ষ মাত্ৰ— তাহদের ব্যক্তিগত বিশেষ মূতি সুস্পষ্ট নহে, কিন্তু পরিণয় প্রণয় ও বিচ্ছেদশোকের একটি সাধারণ ভাব ও রস সেই সর্গে উচ্ছলিত হইতেছে। কুমারসম্ভবে হরপার্বতীকে অবলম্বন করিয়া প্রেম সৌন্দর্য উপমা বর্ণনা তরঙ্গিত হইয়া উঠিয়াছে । মন্থন্ত ও সংসারের বিশেষত্বের প্রতি সেকালের সেই অপেক্ষাকৃত ঔদাসীন্ত থাকাতে ভাষা— বর্ণনা— মকুন্যকে ও ঘটনাকে সর্বত্র আচ্ছন্ন করিয়া আপন রস বিস্তার করিয়াছে। সেই কথাটি স্মরণ রাশিয়া আধুনিক কালের বিশেষত্ব বিশ্বত হইয়া কাদম্বরীর রসাস্বাদে প্রবৃত্ত হইলে আনন্দের সীমা থাকিবে না । কল্পনা করিয়া দেখো গায়ক গান গাহিতেছে, চি-ল-ত-রা-আ-আ-আ-আ’ ফিরিয়া পুনরায় ‘চ-ল-ত-র আ আ আ সুদীর্ঘ তান— শ্রোতারা সেই তানের খেলায় উন্মত্ত হইয়া উঠিয়াছে। এ দিকে গানের কথায় আছে ‘চলত রাজকুমারী, কিন্তু তানের উপদ্রবে বেলা বহিয়া যায়, রাজকুমারীর আর চলাই হয় না। সমজদার শ্রোতাকে জিজ্ঞাসা করিলে সে বলে, রাজকুমারী না চলে তো নাই চলুক, কিন্তু তানট চলিতে থাক। অবশু, রাজকুমারী কোন পথে চলিতেছেন সে সংবাদের জন্ত যাহার বিশেষ উবেগ আছে তাহার পক্ষে তানটা দুঃসহ ; কিন্তু উপস্থিত ক্ষেত্রে যদি রস উপভোগ করিতে চাও, তবে রাজকুমারীর গম্যস্থান-নির্ণয়ের জন্য নিরতিশয় অধীর না হইয়া তানটা শুনিয়া লও। কারণ, যে জায়গায় জাসিয়া পড়িয়াছ এখানে কৌতুহলে জীর হইয় ফল নাই, ইহা রসে মাতোয়ার হইবার স্থান। অতএব স্নিগ্ধজলনির্ঘোৰে আপাতত শূন্ত্রক রাজার বর্ণনা শোনা যাক। সে বর্ণনায় আমরা পুত্রক রাজার চরিত্রচিত্র প্রত্যাশা করিব না। কারণ, চরিত্রচিত্রে একটা সীমা-রেখা অঙ্কিত করিতে হয়— ইহাতে সীমা নাই— তাৰ কল্লোলমুখর সমূত্রে বস্তার স্থায় যত দূর উবেল হইয়াছে