পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VOOS রবীন্দ্র-রচনাবলী সুদৰ্শনা । সে আমি জানি নে, কিন্তু আমার ইচ্ছে করছে- সমস্ত ছারখার হয়ে যাক ! অতবড়ো রানীর পদ এক মুহুর্তে বিসর্জন দিয়ে এলুম, সে কি এমনি কোণে লুকিয়ে ঘর ঝাট দেবার জন্যে। মশাল জ্বলে উঠবে না ? ধরণী কেঁপে উঠবে না ? আমার পতন কি শিউলি ফুলের খসে পড়া। সে কি নক্ষত্রের পতনের মতো অগ্নিময় হয়ে দিগন্তকে বিদীর্ণ করে দেবে না । সুরঙ্গমা । দাবানল জ্বলে ওঠবার আগে গুমরে গুমরে ধোওয়ায়— এখনো সময় যায় নি । সুদৰ্শন। রানীর মহিমা ধূলিসাৎ করে দিয়ে বাইরে চলে এলুম, এখানে আর কেউ নেই যে আমার সঙ্গে মিলবে ? একলা- একলা আমি ! আমার এতবড়ো ত্যাগ গ্রহণ করে নেবার জন্যে কেউ এক পা'ও বাড়বে না ? সুরঙ্গমা | একলা তুমি না- একলা না । সুদর্শনা । সুরঙ্গমা, তোর কাছে সত্যি করে বলছি, আমাকে পাবার জন্যে প্রাসাদে আগুন লাগিয়েছিল, এতেও আমি রাগ করতে পারি নি- ভিতরে ভিতরে আনন্দে আমার বুক কেঁপে কেঁপে উঠছিল। এতবড়ো অপরাধ ! এতবড়ো সাহস ! সেই সাহসেই আমার সাহস জাগিয়ে দিলে, সেই আনন্দেই আমার সমস্ত ফেলে দিয়ে আসতে পারলুম। কিন্তু সে কি কেবল আমার কল্পনা ! আজি কোথাও তার চিহ্ন দেখি নে কেন । । সুরঙ্গমা । তুমি যার কথা মনে ভাবিছ সে তো আগুন লাগায় নি, আগুন লাগিয়েছিল কাঞ্চীরাজ । সুদৰ্শনা । ভীরু ! ভীরু ! অমন মনোমোহন রূপ- তার ভিতরে মানুষ নেই। এমন অপদার্থের জন্যে নিজেকে এতবড়ো বঞ্চনা করেছি ? লজ্জা ! লজ্জা ! কিন্তু সুরঙ্গমা, তোর রাজার কি উচিত ছিল না। আমাকে এখনো ফেরাবার জন্যে আসে । (সুরঙ্গমা নিরুত্তর) তুই ভাবছিস, ফেরবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছি ! কখনো না । রাজা এলেও আমি ফিরতুম না । কিন্তু সে একবার বারণও করলে না ! চলে যাবার দ্বার একেবারে খোলা রইল ! বাইরের নিরাবরণ রাস্তা রানী বলে আমার জন্যে একটু বেদনা বোধ করলে না ? সেও তোর রাজার মতোই কঠিন ? দীনতম পথের ভিক্ষুকও তার কাছে যেমন আমিও তেমনি ! চুপ করে রাইলি যে । বল-না, তোর রাজার এ কিরকম ব্যবহার ! সুরঙ্গমা। সে তো সবাই জানে— আমার রাজা নিষ্ঠুর, কঠিন, তাকে কি কেউ কোনোদিন টলাতে PiT3 | সুদৰ্শনা। তবে তুই তাকে দিনরাত্রি এমন ডাকিস কেন । সুরঙ্গমা। সে যেন এইরকম পর্বতের মতোই চিরদিন কঠিন থাকে- আমার কান্নায়, আমার ভাবনায় সে যেন টলমল না করে। আমার দুঃখ আমারই থাক, সেই কঠিনেরই জয় হােক । সুদৰ্শনা। সুরঙ্গমা, দেখ তো, ঐ মাঠের পারে পূর্বদিগন্তে যেন ধুলো উড়ছে। সুরঙ্গমা । হা, তাই তো দেখছি। সুদৰ্শন । ঐ-যে, রথের ধরজার মতো দেখাচ্ছে না ? সুরঙ্গমা । হা, ধ্বজাই তো বটে। সুদৰ্শনা। তবে তো আসছে। তবে তো এল ! সুরঙ্গমা । কে আসছে। সুদৰ্শনা। আবার কে ! তোর রাজা। থাকতে পারবে কেন । এতদিন চুপ করে আছে। এই আশ্চর্য। সুরঙ্গমা । না, এ আমার রাজা নয় । সুদৰ্শন । না বৈকি ! তুমি তো সব জান ! ভারি কঠিন তোমার রাজা ! কিছুতেই টলেন না ! দেখি কেমন নাটলেন । আমি জানতুম সে ছুটে আসবে। কিন্তু মনে রাখিস সুরঙ্গমা, আমি তাকে একদিনের জন্যেও ডাকি নি । আমার কাছে তোমার রাজা কেমন করে হার মানে এবার দেখে নিয়ো । সুরঙ্গমা, যা একবার বেরিয়ে গিয়ে দেখে আয় গে। (সুরঙ্গমার প্রস্থান) রাজা এসে আমাকে ডাকলেই বুঝি যাব ? কখনো না । আমি যাব না, যাব না।