পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(RGR6 ○○○ নগ্নদেহ, নারী । তা ছাড়া দেয়ালে কোথাও বা চীনে বাসন, মোরাদবাদি পিতলের থালা, জাপানি পাখা, তিব্বতি চামর ইত্যাদি যতপ্রকার অসংগত পদার্থের অস্থানে অযথা সমাবেশ। এই সমস্ত গৃহসজ্জা পছন্দকরা, কেনা এবং সাজানোর ভার মধুসূদনের ইংরেজ অ্যাসিস্টান্টের উপর। এ ছাড়া মকমলে বা রেশমে মোড়া চৌকি-সোফার অরণ্য । কাচের আলমারিতে জমকালো-বাধানো ইংরেজি বই, ঝাড়ন-হস্ত বেহারিা ছাড়া কোনো মানুষ তার উপর হস্তক্ষেপ করে না- টিপাইয়ে আছে অ্যালবাম, তার কোনোটাতে ঘরের লোকের ছবি, কোনোটাতে বিদেশিনী অ্যাকট্রেসদের । অন্তঃপুরে একতলার ঘরগুলো অন্ধকার, সঁ্যাতসেঁতে, ধোয়ায় ঝুলে কালো ৷ উঠোনে আবর্জনাসেখানে জলের কল, বাসন মাজা কাপড় কাচা চলছেই, যখন ব্যবহার নেই তখনো কল প্ৰায় খোলাই থাকে। উপরের বারান্দা থেকে মেয়েদের ভিজে কাপড় ঝুলছে, আর দাড়ের কাকাতুয়ার উচ্ছিষ্ট ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে উঠোনে । বারান্দার দেয়ালের যেখানে-সেখানে পানের পিকের দাগ ও নানাপ্রকার মলিনতার অক্ষয় স্মৃতিচিহ্ন। উঠোনের পশ্চিম দিকের রোয়াকের পশ্চাতে রান্নাঘর, সেখান থেকে রান্নার গন্ধ ও কয়লার ধোয়া উপরের ঘরে সর্বত্রই প্রসার লাভ করে । রান্নাঘরের বাইরে প্রাচীরবদ্ধ অল্প একটু জমি আছে, তারই এক কোণে পোড়া কয়লা, চুলোর ছাই, ভাঙা গামলা, ছিন্ন ধামা, জীর্ণ ঝাঝারি রাশীকৃত ; অপর প্রান্তে গুটিদুয়েক গাই ও বাছুর বাধা, তাদের খড় ও গোবর জমছে, এবং সমস্ত প্রাচীর ঘুটের চক্রে আচ্ছন্ন। এক ধারে একটিমাত্র নিমগাছ, তার গুড়িতে গোরু বেঁধে বেঁধে বাকল গেছে উঠে, আর ক্রমাগত ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে তার পাতা কেড়ে নিয়ে গাছটাকে জেরবার করে দিয়েছে। অন্তঃপুরে এই একটুমাত্র জমি, বাকি সমস্ত জমি বাইরের দিকে । সেটা লতামণ্ডপে, বিচিত্র ফুলের কেয়ারিতে, ছাঁটা ঘাসের মাঠে, খোয়া ও সুরকি -দেওয়া রাস্তায়, পাথরের মূর্তি ও লোহার বেঞ্চিতে সুসজ্জিত । অন্দরমহলে তেতলায় কুমুদিনীর শোবার ঘর। মস্ত বড়ো খাট মেহগনি কাঠের ; ফ্রেমে নেটের মশারি, তাতে সিঙ্কের ঝালর । বিছানার পায়ের দিকে পুরো বহরের একটা নিরাবরণ মেয়ের ছবি, বুকের উপর দুই হাত চেপে লজার ভান করছে। শিয়রের দিকে মধুসূদনের নিজের অয়েলপেন্টিং, তাতে তার কাশ্মীরি শালের কারুকার্যটাই সব চেয়ে প্রকাশমান । এক দিকে দেয়ালের গায়ে কাপড় রাখবার দেরাজ, তার উপরে আয়না ; আয়নার দু দিকে দুটাে চীনেমাটির শামাদান, সামনে চীনেমাটির থালির উপর পাউডারের কীেটাে, রুপো-বাধানো চিরুনি, তিন-চার রকমের এসেন্স, এসেন্স ছিটোবার পিচকারি এবং আরো নানা রকমের প্রসাধনের সামগ্ৰী, বিলিতি অ্যাসিস্টান্টের কেনা। নানশাখাযুক্ত গোলাপি কঁাচের ফুলদানিতে ফুলের তোড়া। আর-এক দিকে লেখবার টেবিল, তাতে দামি পাথরের দোয়াতদান, কলম ও কাগজকাটা । ইতস্তত মোটা গদিওয়ালা সোফা ও কেদারা- কোথাও-বা টিপাই, তাতে চা খাওয়া যায়, তাসখেলা যেতেও পারে। নতুন মহারানীর উপযুক্ত শয়নঘর কী রকম হওয়া বিধিসংগত। এ কথা মধুসূদনকে বিশেষভাবে চিন্তা করতে হয়েছে। এমন হয়ে উঠল, যেন অন্দরমহলের সর্বোচ্চতলার এই ঘরটি ময়লা-কঁথা-গায়ে-দেওয়া ভিখিরির মাথায় জরিজহরাত-দেওয়া পাগড়ি । অবশেষে এক সময়ে গোলমাল-ধুমধামের বানডাকা দিন পার হয়ে রাত্রিবেলা কুমু এই ঘরে এসে পীেছল । তাকে নিয়ে এল সেই মোতির মা । সে ওর সঙ্গে আজ রাত্রে শোবে ঠিক হয়েছে । আরো একদল মেয়ে সঙ্গে সঙ্গে আসছিল। তাদের কৌতুহল ও আমোদের নেশা মিটতে চায় না— মোতির মা তাদের বিদায় করে দিয়েছে। ঘরের মধ্যে এসেই এক হাতে সে ওর গলা জড়িয়ে ধরে বললে, “আমি কিছুখনের জন্যে যাই ঐ পাশের ঘরে—তুমি একটু কেঁদে নাও ভাই, চােখের জল যে বুক ভরে জমে উঠেছে।” বলে সে চলে গেল । কুমু চৌকির উপর বসে পড়ল। কান্না পরে হবে, এখন ওর বড়ো দরকার হয়েছে নিজেকে ঠিক করা । ভিতরে ভিতরে সকলের চেয়ে যে-ব্যথাটা ওকে বাজছিল সে হচ্ছে নিজের কাছে নিজের । অপমান। এতকাল ধরে ও যা-কিছু সংকল্প করে এসেছে। ওর বিদ্রোহী মন সম্পূর্ণ তার উলটাে দিকে