পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

と ܔ রবীন্দ্র-রচনাবলী মাসহারা বরাদ । আত্মীয় বলে ও কাউকে মানে না । এ বাড়িতে কর্তা থেকে চাকর-চাকরানী পর্যন্ত সবাই গোলাম ।” কুমু একটু চুপ করে থেকে বললে, “আমি সেই গোলামিই করব। আমার রোজাকার খোরপোশ হিসেবমত রোজ রোজ শোধ করব ! আমি এ বাড়িতে বিনা মাইনের স্ত্রী-বাদী হয়ে থাকব না | চলো আমাকে কাজে ভরতি করে নেবে। ঘরকন্নার ভার তোমার উপরেই তো— আমাকে তুমি তোমার অধীনে খাটিয়ে নিয়ো, আমাকে রানী বলে কেউ যেন ঠাট্টা না করে ।” মোতির মা হেসে কুমুর চিবুক ধরে বললে, “তা হলে তো আমার কথা মানতে হবে । আমি হুকুম করছি, চলো এখন খেতে ।” ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে কুমু বললে, “দেখো ভাই, নিজেকে দেব বলেই তৈরি হয়ে এসেছিলুম, কিন্তু ও কিছুতেই দিতে দিলে না। এখন দাসী নিয়েই থাকুক। আমাকে পাবে না।” মোতির মা বললে, “কাঠুরে গাছকে কাটতেই জানে, সে গাছ পায় না, কাঠ পায় । মালী গাছকে রাখতে জানে, সে পায় ফুল, পায় ফল । তুমি পড়েছ কাঠুরের হাতে, ও যে ব্যাবসাদার। ওর মনে দরদ নেই কোথাও ।” এক সময়ে শোবার ঘরে ফিরে এসে কুমু দেখলে, তার টিপাইয়ের উপর একশিশি লিজেঞ্জস । হাবলু তার ত্যাগের অর্ঘ্য গোপনে নিবেদন করে নিজে কোথায় লুকিয়েছে। এখানে পাষাণের ফাক দিয়েও ফুল ফোটে । বালকের এই লজেঞ্জসের ভাষায় একসঙ্গে ওকে কঁদোলে হাসালে । তাকে খুঁজতে বেরিয়ে দেখে বাইরে সে দরজার আড়ালে চুপ করে দাড়িয়ে আছে। মা তাকে এ ঘরে যাতায়াত করতে বারণ করেছিল। তাঁর ভয় ছিল পাছে কোনো কিছু উপলক্ষে কর্তার বিরক্তি ঘটে । মোটের উপরে মধুসূদনের নিজের কাজ ছাড়া অন্য বাবদে তার কাছ থেকে সম্পূর্ণ দূরে থাকাই নিরাপদ, এ কথা এ বাড়ির সবাই জানে । কুমু হাবলুকে ধরে ঘরে নিয়ে এসে কোলে বসালে । ওর গৃহসজ্জার মধ্যে পুতুলজাতীয় যা-কিছু জিনিস ছিল সেইগুলো দুজনে নাড়াচাড়া করতে লাগল। কুমু বুঝতে পারলে একটা কাগজচাপা হাবলুর ভারি পছন্দ- কাচের ভিতর দিয়ে রঙিন ফুল যে কী করে দেখা যাচ্ছে সেইটে বুঝতে না পেরে ওর ভারি তাক লেগেছে । কুমু বললে, “এটা নেবে গোপাল ?” এতবড়ো অভাবনীয় প্রস্তাব ওর বয়সে কখনো শোনে নি। এমন জিনিসও কি ও কখনো আশা করতে পারে ? বিস্ময়ে সংকোচে কুমুর মুখের দিকে নীরবে চেয়ে রইল । কুমু বললে, “এটা তুমি নিয়ে যাও।” হাবলু আহলাদ রাখতে পারলে না- সেটা হাতে নিয়েই লাফাতে লাফাতে ছুটে চলে গেল । সেইদিন বিকেলে হাবলুর মা এসে বললে, “তুমি করেছ কী ভাই ? হাবলুর হাতে কঁাচের কাগজচাপা দেখে বড়েঠাকুর হুলস্থূল বাধিয়ে দিয়েছে ৷ কেড়ে তো নিয়েইছে— তার পর তাকে চাের বলে মাের। ছেলেটাও এমনি, তোমার নামও করে নি। হাবলুকে আমিই যে জিনিসপত্র চুরি করতে শেখাচ্ছি। এ কথাও ক্রমে উঠবে।” কুমু কাঠের মূর্তির মতো শক্ত হয়ে বসে রইল। এমন সময়ে বাইরে মচুমাচু শব্দে মধুসূদন আসছে। মেতির মা তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেল। মধুসূদন কঁচের কাগজচাপা হাতে করে যথাস্থানে ধীরে ধীরে সেটা গুছিয়ে রাখলে । তার পরে নিশ্চিতপ্রত্যয়ের কণ্ঠে শান্ত গভীর স্বরে বললে, “হাবলু তোমার ঘর থেকে এটা চুরি করে নিয়েছিল। জিনিসপত্র সাবধান করে রাখতে শিখো ।” কুমু তীক্ষ স্বরে বললে, “ও চুরি করে নি।” “আচ্ছা, বেশ, তা হলে সরিয়ে নিয়েছে।” “না, আমিই ওকে দিয়েছি।”