পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ \9ዒ ፩s W8 কুমুর পালাবার একটিমাত্র জায়গা আছে, এ বাড়ির ছাদ । সেইখানে চলে গেল। বেলা হয়েছে, প্রখর রৌদ্রে ছাদ ভরে গেছে, কেবল প্রাচীরের গায়ে এক জায়গায় একটুখানি ছায়া । সেইখানে গিয়ে বসল। একটি গান মনে পড়ল, তার সুরটি আশাবরী । সে গানের আরম্ভটি হচ্ছে, “বাঁশরী হমারি রে"- কিন্তু বাকিটুকু ওস্তাদের মুখে মুখে বিকৃত বাণী- তার মানে বুঝতে পারা যায় না। কুমু ঐ অসম্পূর্ণ অংশ আপনি ইচ্ছামত নূতন নূতন তান দিয়ে ভরিয়ে পালটে পালটে গাইতে লাগল। ঐ একটুখানি কথা অর্থে ভরে উঠল। ঐ বাক্যটি যেন বলছে, ‘ও আমার বাঁশি, তোমাতে সুর ভরে উঠছে। না কেন ? অন্ধকার পেরিয়ে পৌঁচচ্ছে না কেন যেখানে দুয়ার রুদ্ধ, যেখানে ঘুম ভাঙল না ? বঁাশরী হমারি রে, বাশারী হমারি রে !” মোতির মা যখন এসে বললে, “চলো ভাই, খেতে যাবে।” তখন সেই ছাদের কোণের একটুখানি ছায়া গেছে লুপ্ত হয়ে, কিন্তু তখন ওর মন সুরে ভরপুর, সংসারে কে ওর পরে কী অন্যায় করেছে সে সমস্ত তুচ্ছ হয়ে গেছে। ওর চিঠি নিয়ে মধুসূদনের যে ক্ষুদ্রতা, যে ক্ষুদ্রতায় ওর মনে তীব্র অবজ্ঞা উদ্যত হয়ে উঠেছিল, সে যেন এই রোদভরা আকাশে একটা পতঙ্গের মতো কোথায় বিলীন হয়ে গেল, তার ক্রুদ্ধ গুঞ্জন মিলিয়ে গেল অসীম আকাশে । কিন্তু চিঠির মধ্যে দাদার যে মেহবাক্য আছে সেটুকু পাবার | জন্যে তার মনের আগ্রহ তো যায় না ! ঐ ব্যগ্রতাটা তার মনে লেগে রইল । খাওয়া হয়ে গেলে আর সে থাকতে পারলে না । মোতির মাকে বললে, “আমি যাই বাইরের ঘরে, চিঠি পড়ে আসি ।” মোতির মা বললে, “আর একটু দেরি হােক, চাকররা সবাই যখন ছুটি নিয়ে খেতে যাবে, তখন (RCR. " কুমু বললে, “না, না, সে বড়ো চুরি করে যাওয়ার মতো হবে । আমি সকলের সামনে দিয়ে যেতে চাই তাতে যে যা মনে করে করুক ।” মোতির মা বললে, “তা হলে চলো আমিও সঙ্গে যাই ।” কুমু বলে উঠল, “না, সে কিছুতেই হবে না। তুমি কেবল বলে দাও কোনদিক দিয়ে যেতে হবে।” মোতির মা অন্তঃপুরের ঝরকা-দেওয়া বারান্দা দিয়ে ঘরটা দেখিয়ে দিলে । কুমু বেরিয়ে এল । ভূত্যেরা সচকিত হয়ে উঠে তাকে প্ৰণাম করলে। কুমু ঘরে ঢুকে ডেস্কের দেরাজ খুলে দেখলে তার চিঠি । তুলে নিয়ে দেখলে লেফাফা খোলা । বুকের ভিতরটা ফুলে উঠতে লাগল, একেবারে অসহ্য হয়ে উঠল । যে বাড়িতে কুমু মানুষ হয়েছে সেখানে এ-রকম অবমাননা কোনোমতেই কল্পনা পর্যন্ত করা যেত না । নিজের আবেগের এই তীব্ৰ প্ৰবলতাতেই তাকে ধাক্কা মেরে সচেতন করে তুলল। সে বলে উঠল, “প্রিয়ঃ প্রিয়ায়াৰ্হসি দেব সোঢ়ম- তবু তুফান থামে না- তাই বার বার বললে। বাইরে যে আরদালি ছিল, আপিসঘরে তাদের বউরানীর এই আপন-মনে মন্ত্র-আবৃত্তি শুনে সে অবাক হয়ে গেল । অনেকক্ষণ বলতে বলতে কুমুর মন শান্ত হয়ে এল। তখন চিঠিখনি সামনে রেখে চৌকিতে বসে হাত জোড় করে স্থির হয়ে রইল। চিঠি সে চুরি করে পড়বে না। এই তার পণ । এমন সময়ে মধুসূদন ঘরে ঢুকেই চমকে উঠে দাঁড়াল-কুমু তার দিকে চাইলেও না। কাছে এসে দেখলে, ডেস্কের উপর সেই চিঠি। জিজ্ঞাসা করলে, “তুমি এখানে যে !” কুমুনীরবে শান্ত দৃষ্টিতে মধুসূদনের মুখের দিকে চাইলে । তার মধ্যে নালিশ ছিল না। মধুসূদন আবার জিজ্ঞাসা করলে, “এ ঘরে তুমি কেন ?” i এই বাহুল্যপ্রশ্নে কুমু অধৈর্যের স্বরেই বললে, “আমার নামে দাদার চিঠি এসেছে কি না। তাই দেখতে এসেছিলেম " সে কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করলে না কেন, এমনতরো প্রশ্নের রাস্তা কাল রাত্তিরে মধুসূদন আপনি বন্ধ করে দিয়েছে। তাই বললে, “এ চিঠি আমিই তোমার কাছে নিয়ে যাচ্ছিলুম, সেজন্যে তোমার Gł \ \ RC