পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

888 রবীন্দ্র-রচনাবলী শোধ তুলতে পারলে এখনই তুলত, কিন্তু জানে সংসার-ব্যবস্থায় মধুসূদনের কাছে মেতির মা’র দাম আছে, সেখানে একটুও নাড়া সইবে না। সেই অবধি দুজনের কথা বন্ধ, পারতপক্ষে মুখ দেখাদেখি নেই। এমনি করে এ বাড়িতে শ্যামার স্থান পূর্বের চেয়ে আরো সংকীর্ণ হয়ে গেছে। কোথাও তার একটুও স্বচ্ছন্দতা নেই। এমন সময় একদিন সন্ধেবেলায় শোবার ঘরে এসে দেখে টেবিলের উপর দেয়ালে হেলানো কুমুর ফোটােগ্রাফ। যে বাজ মাথায় পড়বে তারই বিদ্যুৎশিখা ওর চােখে এসে পড়ল। যে মাছকে বড়শি বিধেছে। তারই মতো করে ওর বুকের ভিতরটা ধড়ফড় ধড়ফড় করতে লাগল। ইচ্ছা করে ছবিটা থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়, পারে না। একদৃষ্টি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকল, মুখ বিবৰ্ণ, দুই চোখে একটা দাহ, মুঠো দৃঢ় করে বন্ধ। একটা কিছু ভাঙতে, একটা কিছু ছিড়ে ফেলতে চায়। এ ঘরে থাকলে এখনই কিছু একটা লোকসান করে ফেলবে এই ভয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। আপনার ঘরে গিয়ে বিছানার উপর উপুড় হয়ে পড়ে চাদরখানা টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেললে। রাত হয়ে এল। বাইরে থেকে বেহারিা খবর দিলে মহারাজ শোবার ঘরে ডেকে পাঠিয়েছেন । বলবার শক্তি নেই যে যাব না। তাড়াতাড়ি উঠে মুখ ধুয়ে একটা বুটিদার ঢাকাই শাড়ি পরে গায়ে একটু গন্ধ মেখে গেল শোবার ঘরে । ছবিটা যাতে চোখে না পড়ে এই তার চেষ্টা । কিন্তু ঠিক সেই ছবিটার সামনেই বাতি- সমস্ত আলো যেন কারও দীপ্ত দৃষ্টির মতো ঐ ছবিকে উদভাসিত করে আছে। সমস্ত ঘরের মধ্যে ঐ ছবিটিই সব চেয়ে দৃশ্যমান। শ্যামা নিয়মমত পানের বাটা নিয়ে মধুসূদনকে পান দিলে, তার পরে পায়ের কাছে বসে পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। যে-কোনো কারণেই হােক আজ মধুসূদন প্রসন্ন ছিল। বিলাতি দোকানের থেকে একটা রুপোর ফোটােগ্রাফের ফ্রেম কিনে এনেছিল। গভীরভাবে শ্যামকে বললে, “এই নাও ” শ্যামাকে সমাদর করবার উপলক্ষেও মধুসূদন মধুর রসের অবতারণায় যথেষ্ট কার্পণ্য করে। কেননা সে জানে ওকে অল্প একটু প্রশ্রয় দিলেই ও আর মর্যাদা রাখতে পারে না। ব্ৰাউন কাগজে জিনিসটা মোড়া ছিল । আস্তে আস্তে কাগজের মোড়কটা খুলে ফেলে বললে, “কী হবে এটা ?” মধুসূদন বললে, “জান না, এতে ফোটােগ্রাফ রাখতে হয়।” । শ্যামার বুকের ভিতরটাতে কে যেন চাবুক চালিয়ে দিলে, বললে, “কার ফোটােগ্রাফ রাখবে ?” “তোমার নিজের । সেদিন সেই যে ছবিটা তোলানো হয়েছে।” “আমার এত সোহাগে কাজ নেই।” বলে সেই ফ্রেমটা ছুড়ে মেজের উপর ফেলে দিলে। মধুসূদন আশ্চর্য হয়ে বললে, “এর মানে কী হ’ল ?” “এর মানে কিছুই নেই।” বলে মুখে হাত দিয়ে কেঁদে উঠল, তার পরে বিছানা থেকে মেজের উপর পড়ে মাথা ঠুকতে লাগল। মধুসূদন ভাবল, শ্যামার কম দামের জিনিস পছন্দ হয় নি, ওর বােধ করি ইচ্ছে ছিল একটা দামি গয়না পায়। সমস্ত দিন আপিসের কাজ সেরে এসে এই উপদ্রবটা একটুও ভালো লাগল না। এ-যে প্রায় হিসটিরিয়া। হিসটিরিয়ার পরে ওর বিষম অবজ্ঞা। খুব একটা ধমক দিয়ে বললে, “ওঠে বলছি, এখনই ওঠে !” শ্যামা উঠে। ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল। মধুসূদন বললে, “এ কিছুতেই চলবে না।” মধুসূদন শ্যামকে বিশেষ ভাবেই জানে। নিশ্চয় ঠাওরেছিল একটু পরেই ফিরে এসে পায়ের তলায় লুটিয়ে পড়ে মাপ চাইবে- সেই সময়ে খুব শক্ত করে দুটাে কথা শুনিয়ে দিতে হবে। দশটা বাজল, শ্যামা এল না। আর-একবার শ্যামার ঘরের দরজার বাইরে থেকে আওয়াজ এল, “মহারাজ বোলায়া ।” শ্যামা বললে, “মহারাজকে বলে আমার অসুখ করেছে।” মধুসূদন ভাবলে, আস্পর্ধা তো কম নয়, হুকুম করলে আসে না। মনে ঠিক করে রেখেছিল আরো খানিক বাদে আসবে। তাও এল না। এগারোটা বাজতে মিনিট পনেরো বাকি। বিছানা ছেড়ে মধুসূদন দ্রুত পদে শ্যামার ঘরে গিয়ে ঢুকল। দেখলে ঘরে আলো