পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

আধুনিক সাহিত্য V যে মহাভারত পাওয়া যায় তাহা ব্যাসের মুখ হইতে বৈশম্পায়ন, বৈশম্পায়নের মুখ হইতে উগ্ৰশ্রবার পিতা, পিতার মুখ হইতে উগ্ৰশ্ৰবা, এবং উগ্ৰশ্রবার মুখ হইতে অন্য কোনো-একজন কবি সংগ্ৰহ করিয়াছেন । দ্বিতীয়ত, এ মহাভারতের মধ্যেও কালক্রমে নানা লোকের রচনা মিশ্রিত হইয়াছে ; তাহা নিঃসংশয়ে বিশ্লিষ্ট করিবার কোনাে নির্ভরযোগ্য উপায় আপাতত স্থির হয় নাই। তৃতীয়ত, অন্যান্য প্রাচীন গ্ৰন্থ হইতে তুলনা-দ্বারা মহাভারতের ঐতিহাসিকতা প্ৰমাণ করিবারও পথ নাই । বঙ্কিম প্রধানত কৃষ্ণচরিত্রকেই উপলক্ষ করিয়া কেবল প্রসঙ্গক্রমে মহাভারতের ঐতিহাসিকতা বিচার করিয়াছেন ; কিন্তু প্ৰথমে প্রমাণ ও বিচার প্রয়োগপূর্বক প্রধানত সমস্ত মহাভারতের ইতিহাস-অংশ বাহির করিলে পর, তবে কৃষ্ণচরিত্রের ঐতিহাসিকতা সন্তোষজনকরপে প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে । উদাহরণস্বরূপে বলিতে পারি, দ্রৌপদীর পঞ্চপতিগ্রহণ প্রামাণিক সত্য কি না, সে বিষয়ে বঙ্কিম সন্দেহ প্রকাশ করিয়াছেন ; অতএব দেখা আবশ্যক, বঙ্কিম যাহাকে মূল মহাভারত বলিতেছেন তাহার সর্বত্র হইতেই দ্ৰৌপদীর পঞ্চপতিগ্রহণ বর্জন করা যায় কি না, এবং বঙ্কিম মহাভারতের যে যে অংশ হইতে কৃষ্ণচরিত্রের ইতিহাস সংকলন করিয়াছেন, সেই সেই অংশে দ্ৰৌপদীর পঞ্চপতিচর্য অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত নাই কি না । বঙ্কিম মহাভারতবর্ণিত যে-সকল ঘটনাকে অনৈতিহাসিক মনে করেন সে-সমস্ত যদি তিনি তঁহার কল্পিত মূল মহাভারত হইতে প্রমাণসহকারে দূর করিয়া দিতে পারেন তবে আমরা তাহার নির্বাচিত অংশকে বিশ্বাসযোগ্য ইতিহাসরূপে গ্ৰহণ করিবার জন্য প্ৰস্তুত হইতে পারি। কিন্তু মহাভারতের ঠিক কতটুকু মূল ঐতিহাসিক অংশ তাহা বঙ্কিম সুস্পষ্টরূপে নির্দিষ্ট করেন নাই, তিনি কেবলমাত্র কৃষ্ণচরিত্রের ধারাটি অনুসরণ করিয়া গিয়াছেন। তিনি এক স্থানে । “আমিও বিশ্বাস করি না যে, যজ্ঞের অগ্নি হইতে দ্রুপদী কন্যা পাইয়াছিলেন, অথবা সেই কন্যার পাচটি স্বামী ছিল । তবে দ্রুপদের ঔরসকন্যা থাকা অসম্ভব নহে, এবং তাহার স্বয়ংবর বিবাহ হইয়াছিল, এবং সেই স্বয়ংবরে অর্জন লক্ষ্যবোধ করিয়াছিলেন,ইহা অবিশ্বাস করিবারও কারণ নাই তার পর, তাহার পাচ স্বামী হইয়াছিল, কি এক স্বামী হইয়াছিল, সে কথার মীমাংসায় আমাদের কোনো প্রয়োজন নাই।’ প্রয়োজন যথেষ্ট আছে। কারণ, বঙ্কিম মহাভারতকে ইতিহাস বলিয়া জ্ঞান করেন এবং সেইজন্যই মহাভারতবর্ণিত কৃষ্ণচরিত্রকে তিনি ঐতিহাসিক বলিয়া গ্ৰহণ করিয়াছেন। দ্ৰৌপদীর পঞ্চস্বামী বিবাহ ব্যাপারটি তুচ্ছ নহে; কিন্তু এতবড়ো ঘটনাটি যদি মিথ্যা হয়, এবং সেই মিথ্যা যদি বঙ্কিমের নির্বাচিত মহাভারতেও স্থান পাইয়া থাকে। তবে তদ্দ্বারা সেই মহাভারতের প্রমাণিকতা হ্রাস ও সেই মহাভারতবর্ণিত কৃষ্ণচরিত্রের ঐতি খর্ব হইয়া আসে ৷ সাক্ষী যখন একমাত্র, তখন তাহার সাক্ষ্যের কোনো-এক বিশেষ অংশ সত্য বলিয়া বিশ্বাস করিতে গেলে সাক্ষ্যের অপরাংশে মিথ্যা সংস্রব। না থাকা আবশ্যক । কিন্তু এত আয়োজন করিয়া অগ্রসর হইতে গেলে সম্ভবত ‘কৃষ্ণচরিত্র গ্ৰন্থখানি বাঙালি পাঠকের অদৃষ্ট জুটিত না । সমুচিত পদ্ধতি অবলম্বন করিয়া সমস্ত মহাভারতের সমূলক অংশ উদ্ধার করা একজন লোকের জীবিতকালে সম্ভব কি না সন্দেহ। অতএব মহাভারতের বিস্তীর্ণ গহন অরণ্যের মধ্যে বঙ্কিম যে এক সংকীর্ণ পথের সূচনা করিয়া দিয়াছেন তাহা আমাদের পক্ষে পরম সৌভাগ্যের কথা, এবং অল্প বিস্ময়ের বিষয় নহে। আমাদের কেবল বক্তব্য এই যে, তাহার কার্য পরিসমাপ্ত হয় নাই। বঙ্কিমের প্রতিভা আমাদিগকে যেখানে উপনীত করিয়াছে সেইখানেই যে আমাদিগকে সন্তুষ্টচিত্তে বসিয়া থাকিতে হইবে, তাহা নহে। তিনি আমাদিগকে অসন্তোষের উদাহরণ দেখাইয়া গিয়াছেন, তাহাই আমাদিগকে অনুসরণ করিতে হইবে ; সচেষ্টভাবে সত্যের রাজ্য বিস্তার করিতে হইবে। তিনি আমাদের হাতে মুক্তাটি দিয়া যান নাই, দৃষ্টান্তসহকারে এই শিক্ষা দিয়াছেন যে, যদি মুক্ত চাও তো