পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

98O রবীন্দ্র-রচনাবলী হইতে হয় । তাহাতে কাজও পূর্বের মতো তেমন সহজে সম্পন্ন হয় না এবং গালিও খাইতে হয় । পুরাতন দাসু যদি দুৰ্ভাগ্যক্রমে উনবিংশ শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করে তবে তাহার আবির্ভাব নিতান্ত অসাময়িক হইয়া পড়ে । সমাজে এরূপ অসাময়িক আবির্ভাব সর্বদা ঘটিয়া থাকে। দসু্য বিস্তর জন্মে, কিন্তু সহস্য তাহাদিগকে চেনা যায় না- অকালে অস্থানে পড়িয়া তাহারা অনেক সময় আপনাদিগকেও চেনে না । এ দিকে তাহারা গাড়ি চড়িয়া বেড়ায়, সংবাদপত্র পড়ে, হুইস্ট খেলে, স্ত্রীসমাজে মধুরালাপ করেকেহ সন্দেহমাত্র করে না যে, এই সাদা কামিজ কালো কোর্তার মধ্যে রবিনহুডের নব অবতার ফিরিয়া বেড়াইতেছে । য়ুরোপের বাহিরে গিয়া ইহারা সহসা পূর্ণশক্তিতে প্রকাশিত হইয়া পড়ে। ধর্মনীতির-আবরণ-মুক্ত সেই উৎকট রুদ্র মূর্তির কথা পূর্বেই বলিয়াছি। কিন্তু যুরোপের সমাজ-মধ্যেই যে-সমস্ত ভস্মাচ্ছাদিত অঙ্গর আছে তাহদেরও উত্তাপ বড়ো অল্প নহে । ইহারাই আজকাল বলিতেছে, বলনীতির সহিত প্রেমনীতিকে যোগ করিলে নীতির নীতিত্ব বাড়িতে পারে, কিন্তু বলের বলতৃত্ব কমিয়া যায় । প্ৰেম দয়া এ-সব কথা শুনিতে বেশ, কিন্তু যেখানে আমরা রক্তপাত করিয়া আপন প্ৰভুত্ব প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি সেখানে যে নীতিদুর্বল নবশতাব্দীর সুকুমারহাদয় শিশু সেণ্টিমেন্টের অশ্রুপাত করিতে আসে তাহাকে আমরা অন্তরের সহিত ঘূণা করি। এখানে সংগীত সাহিত্য শিল্পকলা এবং শিষ্টাচার, সেখানে উলঙ্গ তরবারি এবং অসংকোচ একাধিপত্য । এইজন্য আমাদের কর্তৃজাতীয়দের মধ্য হইতে আজকাল দুই সুরের গলা শুনা যায়। একদল প্রবলতার পক্ষপাতী, আর একদল প্রেম এবং শান্তি এবং সুবিচার জগতে বিস্তার করিতে চাহে । জাতির হৃদয় এইরূপে বিভক্ত হইয়া গেলে বলের খর্বত হয়- আপনি আপনাকে বাধা দিতে থাকে। আজকাল ভারতবষীয় ইংরাজ সম্প্রদায় ইহাই লইয়া সুতীব্ৰ আক্ষেপ করে । তাহারা বলে, আমরা কিছু জোরের সহিত যে কাজটা করিতে চাই ইংলভীয় ভ্রাতারা তাহাতে বাধা দিয়া বসে, সকল কথাতেই নৈতিক কৈফিয়ত দিতে হয়। যখন দাসু ব্লেক সমুদ্রদিগবিজয় করিয়া বেড়াইত, যখন ক্লাইব ইংরাজের ছেলের এক ছটাক জমি মিলিত না । কিন্তু এমন করিয়া যতই বিলাপ কর, কিছুতেই আর সেই অখণ্ড দোর্দণ্ড বলের বয়সে ফিরিয়া যাইতে পরিবে না। এখন কোনো জুলুমের কাজ করিতে বসিলেই সমস্ত দেশ ব্যাপিয়া একটা দ্বিধা উপস্থিত হইবে । এখন যদি কোনো নিপীড়িত ব্যক্তি ন্যায়বিচার প্রার্থনা করে তবে স্বার্থহানির সম্ভাবনা থাকিলেও নিদেন গুটিকতক লোকও তাহার সদবিচার করিতে উদ্যত হইবে। এখন একজন ব্যক্তিও যদি ন্যায়ের দোহাই দিয়া উঠিয়া দাঁড়ায় তবে প্রবল স্বার্থপরতা হয় লজ্জায় কিঞ্চিৎ সংকুচিত হইয়া পড়ে, নয়। ন্যায়েরই ছদ্মবেশ ধারণ করিতে চেষ্টা করে । অন্যায় অনীতি যখন বলের সহিত আপনাকে অসংকোচে প্রকাশ করিত তখন বল ব্যতীত তাহার আর-কোনাে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না, কিন্তু যখনই সে আপনাকে আপনি গোপন করিতে চেষ্টা করে এবং বলের সহিত আপন কুটুম্বিতা অস্বীকার করিয়া ন্যায়কে আপনি পক্ষে টানিয়া বলী হইতে চায় তখনই সে আপনি আপনার শক্ৰতা সাধন করে । এইজন্য বিদেশে ইংরাজ আজকাল কিঞ্চিৎ দুর্বল এবং সেজন্য সে সর্বদা অধৈৰ্য প্রকাশ করে। আমরাও সেইজন্য ইংরাজের দোষ পাইলে তাহাকে দোষী করিতে সাহসী হই । সেজন্য ইংরাজ প্রভুরা কিছু রাগ করে। তাহারা বলে, নবাব যখন যথেচ্ছাচারী ছিল, বগি যখন লুটপাট করিত, ঠগি যখন গলায় ফাসি লাগাইত, তখন তোমাদের কনগ্রেসের সভাপতি এবং সংবাদপত্রের সম্পাদক ছিল কোথায়। কোথাও ছিল না এবং থাকিলেও কোনাে ফল হইত না। তখন গোপন বিদ্রোহী ছিল, মারহাট্ট এবং রাজপুত ছিল, তখন বলের বিরুদ্ধে বল ছাড়া গতি ছিল না। তখন চোরার নিকট ধর্মের কাহিনী উত্থাপন করিবার কথা কাহারও মনেও উদয় হইত না । আজ যে কনগ্রেস এবং সংবাদপত্রের অভু্যদয় হইয়াছে তাহার কারণই এই যে, ইংরাজের মধ্যে