পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

36 32feb \ტ8(? অনুভব করিয়া একান্ত মর্মাহত হই । দোষী অব্যাহতি পাওয়া দোষের বটে, কিন্তু আদালতের বিচারের নিকট অদৃষ্টবাদী ভারতবর্ষ । অসম্ভব কিছু প্ৰত্যাশা করে না। আইন এতই জটিল, সাক্ষ্য এতই পিচ্ছিল, এবং দেশীয় চরিত্র-জ্ঞান মমত্বহীন অবজ্ঞাকারী বিদেশীয়ের পক্ষে এতই দুর্লভ যে, অনিশ্চিত ফুল মকদ্দমা অনেকটা জুয়াখেলার মতো বোধ হয়। এইজন্যই জুয়াখেলার যেমন একটা মোহকারী উত্তেজনা আছে, আমাদের দেশের অনেক লোকের কাছে মকদ্দমার সেইরূপ একটা মাদকতা দেখা যায় । অতএব মকদ্দমার ফলের অনিশ্চয়তা সম্বন্ধে যখন সাধারণের একটা ধারণা আছে এবং যখন সে অনিশ্চয়তা-জন্য আমাদের স্বভাবদোষও অনেকটা দায়ী, তখন মধ্যে মধ্যে নির্দোষীর পীড়ন ও দোষীর নিস্কৃতি শোচনীয় অথচ অবশ্যম্ভাবী বলিয়া দেখিতে হয় । কিন্তু বারংবার যুরোপীয় অপরাধীর অব্যাহতি এবং তৎসম্বন্ধে কর্তৃপক্ষীয়ের ঔদাসীন্যে ভারতবষীয়ের প্রতি ইংরাজের আন্তরিক অবজ্ঞার পরিচয় দেয় । সেই অপমানের ধিক্কার শেলের ন্যায় স্থায়ীভাবে হৃদয়ে বিধিয়া থাকে । যদি ঠিক বিপরীত ঘটনা ঘটিত, যদি স্বল্পকালের মধ্যে অনেকগুলি য়ুরোপীয় দেশীয় কর্তৃক হত হইত এবং প্রত্যেক অভিযুক্তই বিচারে মুক্তি পাইত, তবে এরূপ দুর্ঘটনার সমস্ত সম্ভাবনা লোপ করিবার সহস্ৰবিধ উপায় উদভাবিত হইত। কিন্তু প্ৰাচ্য ভারতবাসী যখন নিরর্থক গুলি খাইয়া লাথি খাইয়া মরে * তখন পাশ্চাত্য কর্তৃপুরুষদের কোনোপ্রকার দুর্ভাবনার লক্ষণ দেখা যায় না। কী করিলে এ-সমস্ত উপদ্রব নিবারণ হইতে পারে সে সম্বন্ধে কোনোরূপ প্রশ্ন উত্থাপন হইতেও শুনা যায় না । । কিন্তু আমাদিগের প্রতি কর্তৃজাতীয়ের এই-যে অবজ্ঞা, সেজন্য প্রধানত আমরাই ধিক্কারের যোগ্য। কারণ, এ কথা কিছুতেই আমাদের বিস্মৃত হওয়া উচিত নয় যে, আইনের সাহায্যে সম্মান পাওয়া যায় না ; সম্মান নিজের হস্তে । আমরা সানুনাসিক স্বরে যে ভাবে ক্রমাগত নালিশ করিতে উদাহরণস্থলে আমরা খুলনার ম্যাজিষ্ট্রেট-কর্তৃক মুহুরি মারার ঘটনা উল্লেখ করিতে পারি। কিন্তু প্রথমেই বলিয়া রাখা আবশ্যক, ডিস্ট্রিক্ট-ম্যাজিষ্ট্রেট বেল-সাহেব অত্যন্ত দয়ালু উন্নতচেতা সহৃদয় ব্যক্তি । এবং ভারতবষীয়ের প্রতি র্তাহার ঔদাসীন্য অথবা অবজ্ঞা নাই। আমাদের বিশ্বাস, তিনি যে মুহুরিকে মারিয়াছিলেন তাহাতে কেবল দুর্ধর্ষ ইংরাজপ্রকৃতির হঠকারিতা প্রকাশ পাইয়াছে, বাঙালি-ঘূণা প্রকাশ পায় নাই। জঠরানল যখন প্ৰজ্বলিত তখন ক্রোধানল সামান্য কারণেই উদ্দীপ্ত হইয়া থাকে, তা বাঙালিরও হয় ইংরাজেরও হয় । অতএব এ ঘটনার প্রসঙ্গে বিজাতিবিদ্বেষের কথা উত্থাপন করা উচিত श की | কিন্তু ফরিয়াদির পক্ষের বাঙালি ব্যারিস্টােরমহাশয় এই মকদ্দমার প্রসঙ্গে বারংবার বলিয়াছেন, মুহুরি-মারা কাজটা ইংরাজের অযোগ্য হইয়াছে, কারণ, বেল-সাহেবের জানা ছিল অথবা জানা উচিত ছিল যে, মুহুরি তাহাকে ফিরিয়া মারিতে পারে না। এ কথা যদি সত্য হয় তবে যথার্থ লজ্জার বিষয় মুহুরির এবং মুহুরির স্বজাতিবর্গের । কারণ, হঠাৎ রাগিয়া প্রহার করিয়া বসা পুরুষের দুর্বলতা, কিন্তু মাির খাইয়া বিনা প্রতিকারে ক্ৰন্দন করা কাপুরুষের দুর্বলতা। এ কথা বলিতে পারি, মুহুরি যদি ফিরিয়া মারিত তবে বেল-সাহেব যথার্থ ইংরাজের ন্যায় তাহাকে মনে মনে শ্রদ্ধা করিতেন । যথেষ্ট অপমানিত হইলেও একজন মুহুরি কোনাে ইংরাজকে ফিরিয়া মারিতে পারে না, এই কথাটি ধ্রুবসত্যরূপে অম্লানমুখে স্বীকার করা এবং ইহারই উপরে ইংরাজকে বেশি করিয়া দোষােৰ্থ করা আমাদের বিবেচনায় নিতান্ত অনাবশ্যক এবং লজ্জাজনক আচরণ । মার খাওয়ার দরুন আইনমতে মুহুরির যে-কোনো প্ৰতিকার প্রাপ্য তাহা হইতে সে তিলমাত্র বঞ্চিত না হয় তৎপ্রতি আমাদের দৃষ্টি রাখা উচিত হইতে পারে, কিন্তু তাহার আঘাত এবং অপমান --বেদনার উপর সমস্ত দেশের লোক মিলিয়া অজস্রপরিমাণে আহা-উহ্য করার এবং কেবলমাত্র বিদেশীকে