পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ > 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী প্ৰতাপ । কে ? তোমাদের যুবরাজ উদয়াদিত্য নাকি ? মন্ত্রী । আজ্ঞা মহারাজ, এমন কথা বলিবেন না । কে করিয়াছে সন্ধান পাই নাই । প্ৰতাপ । যেই করুক, তাহার জন্য অধিক ভাবিয়ো না, আমিই দিল্লীশ্বরের বিচারকর্তা, আমিই তাহার দণ্ডের উদযোগ করিতেছি । সে পাঠানেরা এখনাে ফিরিল না ? উদয়াদিত্য এখনাে আসিল না ? শীঘ প্রহরীকে ডাকো । তৃতীয় পরিচ্ছেদ বিজন পথ দিয়া বিদ্যুদবেগে যুবরাজ অশ্ব ছুটািইয়া চলিয়াছেন । অন্ধকার রাত্রি, কিন্তু পথ দীর্ঘ সরল প্রশস্ত বলিয়া কোনো ভয়ের আশঙ্কা নাই । স্তব্ধ রাত্রে অশ্বের খুরের শব্দে চারি দিক প্ৰতিধ্বনিত হইতেছে, দুই-একটি কুকুর ঘেউ-ঘেউ করিয়া ডাকিয়া উঠিতেছে, দুই-একটা শৃগাল চকিত হইয়া পথ ছাড়িয়া বাশঝাড়ের মধ্যে লুকাইতেছে । আলোকের মধ্যে আকাশের তারা ও পথপ্ৰান্তস্থিত গাছে জোনাকি ; শব্দের মধ্যে ঝিঝি পোকার অবিশ্রাম শব্দ, মনুষ্যের মধ্যে কঙ্কাল-অবশেষ একটি ভিখারি বৃদ্ধ গাছের তলায় ঘুমাইয়া আছে। পাচ ক্রোশ পথ অতিক্ৰম করিয়া যুবরাজ পথ ছাড়িয়া একটা মাঠে নামিলেন । অশ্বের বেগ অপেক্ষাকৃত সংযত করিতে হইল। দিনের বেলায় বৃষ্টি হইয়াছিল, মাটি ভিজা ছিল, পদে পদে অশ্বের পা বসিয়া যাইতেছে । যাইতে যাইতে সম্মুখের পায়ে ভর দিয়া অশ্ব তিন বার পডিয়া গেল । শ্রান্ত অশ্বের নাসারন্ধ বিস্ফারিত, মুখে ফেন, পশ্চাতের পদদ্বয়ের ঘর্ষণে ফেন জন্মিয়াছে, পঞ্জরের ভিতর হইতে একটা শব্দ বাহির হইতেছে, সৰ্ব্বাঙ্গ ঘর্মে প্লাবিত । এ দিকে দারুণ গ্রীষ্ম, বাতাসের লেশমাত্ৰ নাই, এখনো অনেকটা পথ অবশিষ্ট রহিয়াছে | বহুতর জলা ও চাষা মাঠ অতিক্ৰম করিয়া যুবরাজ অবশেষে একটা কঁচা রাস্তায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন । অশ্বকে আবার দ্রুতবেগে ছুটািইলেন । একবার তাহার স্কন্ধ চাপড়াইয়া উৎসাহ দিয়া ডাকিলেন, “সুগ্ৰীব ।” সে চকিতে একবার কান খাড়া করিয়া বড়ো বড়ো চোখে বঙ্কিম দৃষ্টিতে প্রভুর দিকে চাহিল, একবার গ্ৰীবা বাকাইয়া হেষাধবনি করিল ও সবলে মুখ নামাইয়া রাশ শিথিল করিয়া লইল ও গ্ৰীবা নত করিয়া উর্ধর্বশ্বাসে ছুটিতে লাগিল। দুই পাশ্বের গাছপালা চােখে ভালো দেখা যাইতেছে না, আকাশে চাহিলে মনে হইতেছে যেন দলে দলে নক্ষত্রেরা অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মতো সবেগে উড়িয়া যাইতেছে এবং সেই স্তব্ধবায়ু আকাশে বায়ু তরঙ্গিত হইয়া কানের কাছে সা সঁা করিতে লাগিল । রাত্রি যখন তৃতীয় প্রহর, লোকালয়ের কাছে শৃগালেরা যখন প্রহর ডাকিয়া গেল, তখন যুবরাজ শিমুলতলির চটির দুয়ারে আসিয়া দাড়াইলেন, তাহার অশ্ব তৎক্ষণাৎ গীতজীবন হইয়া ভূমিতে পড়িয়া গেল । নামিয়া তাহার পিঠ চাপড়াইলেন, তাহার মুখ তুলিয়া ধরিলেন, “সুগ্ৰীব” বলিয়া কতবার ডাকিলেন, সে আর নড়িল না ! দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া যুবরাজ দ্বারে গিয়া আঘাত করিলেন । বার বার আঘাতের পর চটির অধ্যক্ষ দ্বার না খুলিয়া জানালার মধ্য দিয়া কহিল, “এত রাত্রে তুমি কে গো ?” দেখিল একজন সশস্ত্র যুবক দ্বারে দাড়াইয়া । যুবরাজ কহিলেন, “একটা কথা জিজ্ঞাসা করিব, দ্বার খোলো ৷” সে কহিল, “দ্বার খুলিবার আবশ্যক কী, যাহা জিজ্ঞাসা করিবার আছে, জিজ্ঞাসা করো-না ।” যুবরাজ জিজ্ঞাসা করিলেন, “রায়গড়ের রাজা বসন্ত রায় এখানে আছেন ?” সে কহিল, “আজ্ঞা, সন্ধ্যার পর তাহার আসিবার কথা ছিল বটে কিন্তু এখনো আসেন নাই । আজ বোধ করি তাহার আসা হইল না ।” যুবরাজ দুইটি মুদ্রা লইয়া শব্দ করিয়া কহিলেন, “এই লও।” সে তাড়াতাড়ি ছুটিয়া আসিয়া দ্বার খুলিয়া মুদ্রা দুইটি লইল । তখন যুবরাজ তাহাকে কহিলেন, “বাপু, আমি একবারটি তোমার চটি অনুসন্ধান করিয়া দেখিব, কে কে আছে ?” চটি-রক্ষক সন্দিগ্ধভাবে কহিল, “না মহাশয়, তাহা হইবে না ।”