পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

१२8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী তবে মা তাকে শাস্তি দিন, কিন্তু মা সন্তানকে একেবারে পরিত্যাগ করে যাবেন এ কি কখনাে হয় ! প্ৰভু, বলে দিন কী করলে মা ফিরে আসবেন ।” রঘুপতি কহিলেন, “তোদের এই রাজা যখন এ রাজ্য হইতে বাহির হইয়া যাইবেন মাও তখন এই রাজ্যে পুনর্বার পদার্পণ করিবেন।” এই কথা শুনিয়া জনতার গুন গুন শব্দ হঠাৎ থামিয়া গেল। হঠাৎ চতুর্দিক সুগভীর নিস্তব্ধ হইয়া গেল, অবশেষে পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে চাহিতে লাগিল ; কেহ সাহস করিয়া কথা কহিতে °ळ्लि । । ስ রঘুপতি মেঘগভীর স্বরে কহিলেন, “তবে তোরা দেখিবি ! আয়, আমার সঙ্গে আয়। অনেক দূর হতে অনেক আশা করিয়া তোরা ঠাকরুনকে দর্শন করিতে আসিয়াছিস— চল, একবার মন্দিরে চল ।” সকলে সভয়ে মন্দিরের প্রাঙ্গণে আসিয়া সমবেত হইল। মন্দিরের দ্বার রুদ্ধ ছিল, রঘুপতি ধীরে ধীরে দ্বার খুলিয়া দিলেন। কিয়ৎক্ষণ কাহারও মুখে বাক্যস্ফুর্তি হইল না। প্রতিমার মুখ দেখা যাইতেছে না, প্রতিমার পশ্চাদ্ভাগ দর্শকের দিকে স্থাপিত। মা বিমুখ হইয়াছেন। সহসা জনতার মধ্য হইতে ক্ৰন্দনধ্বনি উঠিল, “একবার ফিরে দাড়া মা ! আমরা কী অপরাধ করেছি!” চারি দিকে “মা কোথায়, মা কোথায়” রব উঠিল । প্রতিমা পাষাণ বলিয়াই ফিরিল না। অনেকে মূৰ্ছা গেল। ছেলেরা কিছু না বুঝিয়া কঁাদিয়া উঠিল। বৃদ্ধের মাতৃহারা শিশুসন্তানের মতো কঁদিতে লাগিল, “মা, ওমা !” স্ত্রীলোকদের ঘোমটা খুলিয়া গেল, অঞ্চল খসিয়া পড়িল, তাহারা বক্ষে করাঘাত করিতে লাগিল। যুবকেরা কম্পিত উর্ধর্বস্বরে বলিতে লাগিল, “মা, তোকে আমরা ফিরিয়ে আনব- তোকে আমরা ছাড়ব না ।” একজন পাগল-গাহিয়া উঠিল-- “মা আমার পাষাণের মেয়ে, সন্তানে দেখলি নে চেয়ে ।” মন্দিরের দ্বারে দাড়াইয়া সমস্ত রাজ্য যেন “মা” “মা” করিয়া বিলাপ করিতে লাগিল— কিন্তু প্রতিমা ফিরিল না। মধ্যাহ্নের সূর্য প্রখর হইয়া উঠিল, প্রাঙ্গণে উপবাসী জনতার বিলাপ থামিল না। তখন জয়সিংহ কম্পিতপদে আসিয়া রঘুপতিকে কহিলেন, “প্ৰভু, আমি কি একটি কথাও কহিতে *श्द न्ा ?” r রঘুপতি কহিলেন, “না, একটি কথাও না।” জয়সিংহ কহিলেন, “সন্দেহের কি কোনো কারণ নাই ?” রঘুপতি দৃঢ়স্বরে কহিলেন, “না ।” জয়সিংহ দৃঢ়রপে মুষ্টি বদ্ধ করিয়া কহিলেন, “সমস্তই কি বিশ্বাস করিব ?” রঘুপতি জয়সিংহকে সুতীব্র দৃষ্টিদ্বারা দগ্ধ করিয়া কহিলেন, “হাঁ।” জয়সিংহ বক্ষে হাত দিয়া কহিলেন, “আমার বক্ষ বিদীর্ণ হইয়া যাইতেছে।” তিনি জনতার মধ্য হইতে ছুটিয়া বাহির হইয়া গেলেন । চতুৰ্দশ পরিচ্ছেদ তাহার পরদিন ২৯শে আষাঢ়। আজ রাত্রে চতুর্দশ দেবতার পূজা । আজ প্ৰভাতে তালবনের আড়ালে সূর্য যখন উঠিতেছে, তখন পূর্ব দিকে মেঘ নাই। কনককিরণ প্লাবিত আনন্দময় কাননের মধ্যে গিয়া জয়সিংহ যখন বসিলেন তখন র্তাহার পুরাতন স্মৃতি-সকল মনে উঠিতে লাগিল। এই বনের মধ্যে এই পাষাণমন্দিরের পাষাণসোপােনাবলীর মধ্যে, এই গোমতীতীরে সেই বৃহৎ বটের ছায়ায়, সেই ছায়া-দিয়া-ঘেরা পুকুরের ধারে তাহার বাল্যকাল সুমধুর স্বপ্নের মতো মনে পড়িতে লাগিল। যে-সকল