পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ88 রবীন্দ্র-রচনাবলী খেলাতে নক্ষত্ররায়ের প্রতি পীতাম্বরের মেহ আরো গাঢ় হইত । আজ প্রাসাদে বিড়াল-শাবকের বিবাহ । নক্ষত্ররায়ের একটি শিশু-বিড়ালী ছিল, তাহার সহিত মণ্ডলদের বিড়ালের বিবাহ হইবে । চুড়োমণি ঘটক ঘটকালির স্বরূপ তিন শত টাকা ও একটা শাল পাইয়াছে। গায়ে-হলুদ প্রভৃতি সমস্ত উপক্ৰমণিকা হইয়া গিয়াছে। আজ শুভলগ্নে সন্ধ্যার সময়ে বিবাহ হইবে । এ কয়দিন রাজবাটীতে কাহারও তিলার্ধ অবসর নাই । সন্ধ্যার সময় পথঘাট আলোকিত হইল, নহবত বসিল । মণ্ডলদের বাড়ি হইতে চতুৰ্দোলায় চড়িয়া কিংখাবের বেশ পরিয়া পাত্র অতি কাতর স্বরে মিউ মিউ করিতে করিতে যাত্ৰা করিয়াছে । মণ্ডলদেৱ বাড়ির ছোটাে ছেলেটি মিত-বরের মতো তাহার গলার দড়িটি ধরিয়া তাহার সঙ্গে সঙ্গে আসিতেছে। উলু-শঙ্খধ্বনির মধ্যে পাত্ৰ সভাস্থ হইল । পুরোহিতের নাম কেনারাম, কিন্তু নক্ষত্ররায় তাহার নাম রাখিয়াছিলেন রঘুপতি । নক্ষত্ররায় আসল রঘুপতিকে ভয় করিতেন, এইজন্য নকল রঘুপতিকে লইয়া খেলা করিয়া সুখী হইতেন । এমন-কি, কথায় কথায় তাহাকে উৎপীড়ন করিতেন ; গরিব কেনারাম সমস্ত নীরবে সহ্য করিত । আজ দৈবদুর্বিপাকে কেনারাম সভায় অনুপস্থিত— তাহার ছেলেটি জ্বরবিকারে মরিতেছে! নক্ষত্ররায় অধীর স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “রঘুপতি কোথায় ?” নক্ষত্ররায় দ্বিগুণ হাকিয়া বলিলেন, “বোলাও উসকো ।” লোক ছুটিল । ততক্ষণে রোরুদ্যমান বিড়ালের সমক্ষে নাচগান চলিতে লাগিল । নক্ষত্ররায় বলিলেন, “সাহানা-গাও ” সাহানা গান আরম্ভ হইল । কিয়ৎক্ষণ পরে ভূত্য আসিয়া নিবেদন করিল, “রঘুপতি আসিয়াছেন।” নক্ষত্ররায় সরোষে বলিলেন, “বোলাও ।” তৎক্ষণাৎ পুরোহিত গৃহে প্রবেশ করিলেন । পুরোহিতকে দেখিয়াই নক্ষত্ররায়ের ভুকুটি কোথায় মিলাইয়া গেল, তাহার সম্পূর্ণ ভাবান্তর উপস্থিত হইল। র্তাহার মুখ বিবৰ্ণ হইয়া গেল, কপালে ঘৰ্ম দেখা দিল । সাহানা-গান সারঙ্গ ও মৃদঙ্গ সহসা বন্ধ হইল ; কেবল বিড়ালের মিউ মিউ ধ্বনি নিস্তব্ধ ঘরে দ্বিগুণ জাগিয়া উঠিল ! এ রঘুপতিই বটে। তাহার। আর সন্দেহ নাই। দীর্ঘ শীর্ণ, তেজস্বী, বহুদিনের ক্ষুধিত কুকুরের মতো চক্ষু দুটাে জ্বলিতেছে। ধুলায় পরিপূর্ণ দুই পা তিনি কিংখাব মছলন্দের উপর স্থাপন করিয়া মাথা তুলিয়া দাড়াইলেন। বলিলেন, “নক্ষত্ররায় !” নক্ষত্ররায় চুপ করিয়া রহিলেন । রঘুপতি বলিলেন, “তুমি রঘুপতিকে ডাকিয়াছ। আমি আসিয়াছি।” রঘুপতি কহিলেন, “উঠিয়া এসো।” r নক্ষত্ররায় ধীরে ধীরে সভা হইতে উঠিয়া গেলেন। বিড়ালের বিয়ে, সাহানা এবং সারঙ্গ, একেবারে বন্ধ হইল । ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ রঘুপতি জিজ্ঞাসা করিলেন, “এ-সব কী হইতেছিল ?” নক্ষত্ররায় মাথা চুলকাইয়া কহিলেন, “নাচ হইতেছিল।” রঘুপতি ঘূণায় কুঞ্চিত হইয়া কহিলেন, “ছি ছি!” নক্ষত্র অপরাধীর ন্যায় দাড়াইয়া রহিলেন । রঘুপতি কহিলেন, “কাল এখান হইতে যাত্রা করিতে হইবে। তাহার উদযোগ করো।”