পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি br(ጰ\e) বেয়ে শহরের মধ্যে উঠলুম। অনেকগুলি গাইড পাণ্ডা। আমাদের ছেকে ধরলে। আমার বন্ধু বহুকষ্টে তাদের তাড়িয়ে দিলেন । কিন্তু একজন কিছুতেই আমাদের সঙ্গ ছাড়লে না । বন্ধু তাকে বারবার বেঁকে বেঁকে বললেন, “চাই নে তোমাকে, একটি পয়সাও দেব না ।” তবু সে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে লেগে ছিল। তার পরে যখন তাকে নিতান্তই তাড়িয়ে দিলে তখন সে স্নানমুখে চলে গেল । আমার তাকে কিছু দেবার ইচ্ছে ছিল কিন্তু সঙ্গে স্বর্ণমুদ্রা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বন্ধু বললেন, লোকটা গরিব সন্দেহ নেই। কিন্তু কোনো ইংরেজ হলে এমন করত না। আসলে মানুষ পরিচিত দোষ গুরুতর হলেও মার্জনা করতে পারে। কিন্তু সামান্য অপরিচিত দোষ সহ্য করতে পারে না । মাল্টা শহরটা দেখে মনে হয় একটা অপরিণত বিকৃত যুরোপীয় শহর। পাথরে বঁাধানো সরু রাস্তা একবার উপরে উঠছে একবার নীচে নামছে। সমস্তই দুৰ্গন্ধ ঘেঁষাৰ্ঘেষি অপরিষ্কার । রাত্রে হােটেলে গিয়ে খেলুম। অনেক দাম দেওয়া গেল, কিন্তু খাদ্যদ্রব্য কদৰ্য । আহারান্তে, শহরের মধ্যে একটি বাধানো চক আছে, সেইখানে ব্যান্ড বাদ্য শুনে রাত দশটার সময় জাহাজে ফিরে আসা গেল। ফেরবার সময় নীেকেওআলা আমাদের কাছ থেকে ন্যায্য ভাড়ার চেয়ে কিছু বেশি আদায়ের চেষ্টায় ছিল। আমার বন্ধু এদের অসৎ ব্যবহারে বিষম রাগান্বিত । তাতে আমার মনে পড়ল এবারে লন্ডনে প্রথম যে-দিন আমরা দুই ভাই গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলুম গাড়োয়ান পাচ শিলিং ভাড়ার জায়গায় আমাদের কাছে বারো শিলিং ঠকিয়ে নিয়েছিল । সে লোকটার তত দোষ ছিল না, দোষ আমাদেরই। আমাদের দুই ভাইয়ের মুখে বোধ করি এমন কিছু ছিল যা দেখলে সৎ লোকেরও ঠকিয়ে নিতে হঠাৎ প্রলোভন হতে পারে । যা হােক মাল্টােবাসীর অসাধু স্বভাবের প্রতি আমার বন্ধুর অতিমাত্র ক্ৰোধ দেখে এ ঘটনাটা উল্লেখ করা আমার কর্তব্য মনে করলুম। ১৮ অক্টোবর । আজ ডিনার-টেবিলে ‘স্মাগ্নিং’ সম্বন্ধে কেউ কেউ নিজ নিজ কীর্তি রটনা করছিলেন । গবমেন্টকে মাশুল ফাকি দেবার জন্যে মিথ্যে প্রতারণা করাকে এরা তেমন নিন্দা বা লজ্জার বিষয় মনে করে না । অথচ মিথ্যা এবং প্রতারণাকে যে এরা দূষণীয় জ্ঞান করে না সে কথা বলাও অন্যায়। মানুষ এমনি জীব ! একজন ব্যারিস্টার তার মক্কেলের কাছ থেকে পুরা ফি নিয়ে যদি কাজ না করে এবং সেজন্যে যদি সে হতভাগ্যের সর্বনাশ হয়ে যায় তা হলেও কিছু লজ্জা বোধ করে না, কিন্তু ঐ মক্কেল যদি তার দেয় ফি'র দুটি পয়সা কম দেয় তা হলে কীেসুলির মনে যে ঘূণামিশ্রিত ১৯ অক্টোবর । আজ সকালে জাহাজ যখন ব্রিন্দিসি পৌঁছল তখন ঘোর বৃষ্টি । এই বৃষ্টিতে এক দল গাইয়ে বাজিয়ে হার্প বেয়ালা ম্যান্ডোলিন নিয়ে ছাতা মাথায় জাহাজের সম্মুখে বন্দরের পথে দাঁড়িয়ে গানবাজনা জুড়ে দিলে । বৃষ্টি থেমে গেলে বন্ধুর সঙ্গে ব্রিন্দিসিতে বেরোনো গেল। শহর ছাড়িয়ে একটা খোলা জায়গায় গিয়ে পৌঁছলুম। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, পাহাড়ে রাস্তা শুকিয়ে গেছে, কেবল দুই ধারের নালার মাঝে মাঝে জল দাড়িয়ে আছে। রাস্তার ধারে গাছে চড়ে দুটাে খালি-পা ইটালিয়ান ছোকরা ফিগ পেড়ে খাচ্ছিল ; আমাদের ডেকে ইশারায় জিজ্ঞাসা করলে, তোমরা খাবে কি ? আমরা বললুম, না। খানিক বাদে দেখি তারা ফলবিশিষ্ট একটা ছিন্ন অলিভ শাখা নিয়ে এসে উপস্থিত। জিজ্ঞাসা করলে, অলিভ খাবে ? আমরা অসম্মত হলুম। তার পরে ইশারায় তামাক প্রার্থনা করে বন্ধুর কাছ থেকে কিঞ্চিৎ তামাক আদায় করলে। তামাক খেতে খেতে দুজনে বরাবর আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলল। আমরা পরস্পরের ভাষা জানি নে— আমাদের উভয় পক্ষে প্রবল অঙ্গভঙ্গিদ্বারা ভাবপ্রকাশ চলতে লাগল। জনশূন্য রাস্তা ক্রমশ উচু হয়ে শস্যক্ষেত্রের মধ্যে দিয়ে বরাবর চলে গিয়েছে। কেবল মাঝে মাঝে এক-একটা ছােটাে বাড়ি, সেখানে জানলার কাছে ফিগ ফল শুকোতে দিয়েছে। এক-এক জায়গায় ছোটাে ছোটাে শাখাপথ বক্ৰধারায় এক পাশ দিয়ে নেমে নীচে কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। । ফেরবার মুখে একটা গোরস্থানে ঢোকা গেল। এখানকার গোর নূতন রকমের । অধিকাংশ গোরের উপরে এক-একটি ছোটো ঘর গেথেছে । সেই ঘর পর্দা দিয়ে, ছবি দিয়ে, রঙিন জিনিস দিয়ে, নানা