পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী ܓ ܬܐb শীর্ণ শূন্য শ্ৰীহীন রূপে চক্ষে পড়ে। মানবাত্মা জিনিসটা যতই উচ্চ হউক-না কেন, দুইবেলা দুইমুষ্টি তণ্ডুল সংগ্ৰহ করিতেই হইবে, একখণ্ড বস্ত্র না হইলে সে মাটিতে মিশাইয়া যায়। এ দিকে আপনাকে অবিনাশী অনন্ত বলিয়া বিশ্বাস করে, ও দিকে যেদিন নাস্যেরা ডিবাটা হারাইয়া যায় সেদিন আকাশ বিদীর্ণ করিয়া ফেলে। যেমন করিয়াই হােক, প্রতিদিন তাহাকে আহার-বিহার কেনা-বেচা দর-দাম মারামারি ঠেলা ঠেলি করিতেই হয়— সেজন্য সে লজ্জিত। এই কারণে সে এই শুষ্ক৷ ধূলিময় লোকাকীর্ণ হাট-বাজারের ইত্যরতা ঢাকিবার জন্য সর্বদা প্ৰয়াস পায় । আহারে।-বিহারে আন্দানে-প্ৰদানে আত্মা আপনার সৌন্দর্যবিভা বিস্তার করিবার চেষ্টা করিতে থাকে । সে আপনার আবশ্যকের সহিত আপনার মহত্ত্বের সুন্দর সামঞ্জস্য সাধন করিয়া লইতে চায় । আমি কহিলাম— তাহারই প্রমাণ এই পুণ্যাহের বঁশি । একজনের ভূমি, আর-একজন তাঁহারই মূল্য দিতেছে, এই শুষ্ক চুক্তির মধ্যে লজ্জিত মানবাত্মা একটি ভাবের সৌন্দর্য প্রয়োগ করিতে চাহে । উভয়ের মধ্যে একটি আত্মীয়সম্পর্ক বাধিয়া দিতে ইচ্ছা করে । বুঝাইতে চাহে ইহা চুক্তি নহে, ইহার মধ্যে একটি প্রেমের স্বাধীনতা আছে । রাজাপ্ৰজা ভাবের সম্বন্ধ, আদানপ্ৰদান হৃদয়ের কর্তব্য । খাজনার টাকার সহিত রাগরাগিণীর কোনো যোগ নাই, খাজাঞ্চিখানা নহবত বাজাইবার স্থান নহে, কিন্তু যেখানেই ভাবের সম্পর্ক আসিয়া দাড়াইল— আমনি সেখানেই বঁাশি তাহাকে আহবান করে, রাগিণী তাহাকে প্রকাশ করে, সৌন্দর্য তাহার সহচর। গ্রামের বাঁশি যথাসাধ্য প্রকাশ করিতে চেষ্টা করিতেছে, আজ আমাদের পুণ্যদিন, আজ আমাদের রাজাপ্রজার মিলন । জমিদারি কাছারিতেও মানবাত্মা আপন প্ৰবেশপথ নির্মাণের চেষ্টা করিতেছে, সেখানেও একখানা ভাবের আসন পাতিয়া রাখিয়াছে । স্রোতস্বিনী। আপনার মনে ভাবিতে ভাবিতে কহিল— আমার বোধ হয় ইহাতে যে কেবল সংসারের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে তাহা নহে, যথার্থ দুঃখভার লাঘব করে । সংসারে উচ্চনীচতা যখন আছেই, সৃষ্টিলোপ ব্যতীত কখনােই যখন তাহা ধ্বংস হইবার নহে, তখন উচ্চ এবং নীচের মধ্যে একটা অবিচ্ছিন্ন সম্বন্ধ থাকিলে উচ্চতার ভার বহন করা সহজ হয় । চরণের পক্ষে দেহভার বহন করা সহজ ; বিচ্ছিন্ন বাহিরের বোঝাই বোঝা । উপমাপ্রয়োগপূর্বক একটা কথা ভালো করিয়া বলিবামাত্র স্রোতস্বিনীর লজ্জা উপস্থিত হয়, যেন একটা অপরাধ করিয়াছে। অনেকে অন্যের ভাব চুরি করিয়া নিজের বলিয়া চালাইতে এরূপ কুষ্ঠিত হয় না | ব্যোম কহিল— যেখানে একটা পরাভব অবশ্য স্বীকার করিতে হইবে সেখানে মানুষ আপনার হীনতাদুঃখ দূর করিবার জন্য একটা ভাবের সম্পর্ক পাতাইয়া লয়। কেবল মানুষের কাছে বলিয়া নয়, সর্বত্রই। পৃথিবীতে প্রথম আগমন করিয়া মানুষ যখন দাবাগ্নি ঝটিকা বন্যার সহিত কিছুতেই পারিয়া উঠিল না, পর্বত যখন শিবের প্রহরী নদীর ন্যায় তর্জনী দিয়া পথরোধপূর্বক নীরবে নীলাকাশ স্পর্শ করিয়া দাড়াইয়া রহিল, আকাশ যখন স্পৰ্শাতীত অবিচল মহিমায় অমোঘ ইচ্ছাবলে কখনো বৃষ্টি কখনো বজ বর্ষণ করিতে লাগিল, তখন মানুষ তাঁহাদের সহিত দেবতা পাতাইয়া বসিল । নহিলে চিরনিবাসভূমি প্রকৃতির সহিত কিছুতেই মানুষের সন্ধিস্থাপন হইত না । অজ্ঞাতশক্তি প্রকৃতিকে যখন প্ৰভুক্তভাবে পরিপূর্ণ করিয়া ফেলিল তখনই মানবায় তাহার মধ্যে গৌরবের সহিত বাস করতে রল | ক্ষিতি কহিল— মানবাত্মা কোনােমতে আপনার গৌরব রক্ষা করিবার জন্য নানাপ্রকার কৌশল করিয়া থাকে সন্দেহ নাই। রাজা যখন যথেচ্ছাচার করে, কিছুতেই তাহার হাত হইতে নিষ্কৃতি নাই, তখন প্ৰজা তাহাকে দেবতা গড়িয়া হীনতাদুঃখ বিস্মৃত হইবার চেষ্টা করে । পুরুষ, যখন সবল এবং একাধিপত্য করিতে সক্ষম তখন অসহায় স্ত্রী তাহাকে দেবতা দাড় করাইয়া তাহার স্বার্থপর নিষ্ঠুর অত্যাচার কথঞ্চিৎ গৌরবের সহিত বহন করিতে চেষ্টা করে । এ কথা স্বীকার করি বটে, মানুষের যদি এইরূপ ভাবের দ্বারা অভাব ঢাকিবার ক্ষমতা না থাকিত তবে এতদিনে সে পশুর অধম হইয়া যাইত । স্রোতস্বিনী ঈষৎ ব্যথিত ভাবে কহিল— মানুষ যে কেবল অগত্যা এইরূপ আত্মপ্রতারণা করে তাহা