পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

S)○○ রবীন্দ্র-রচনাবলী বলিতেছেন। কলের দ্বারা মানুষের পূর্ণতা-সাধন হয় না । আধুনিক যুরোপ বলে- আশা করিয়ো না, বিশ্বাস করিয়ো না, কেবল পরীক্ষা করে । নবীনা সভ্যতা যেন এক বৃদ্ধ পতিকে বিবাহ করিয়াছে, তাহার সমৃদ্ধি আছে, কিন্তু যৌবন নাই ; সে আপনার সহস্র পূর্ব অভিজ্ঞতার দ্বারা জীর্ণ। উভয়ের মধ্যে ভালোরূপ প্রণয় হইতেছে না, গৃহের মধ্যে কেবল অশান্তি । এই-সমস্ত আলোচনা করিয়া আমি এই পল্লীর ক্ষুদ্র সম্পূর্ণতার সৌন্দর্য দ্বিগুণ আনন্দে সম্ভোগ করিতেছি । তাই বলিয়া আমি এমন অন্ধ নাহি যে, য়ুরোপীয় সভ্যতার মর্যাদা বুঝি না । প্রভেদের মধ্যে ঐক্যই ঐক্যের পূর্ণ আদর্শ, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই সৌন্দর্যের প্রধান কারণ। সম্প্রতি য়ুরোপে সেই প্রভেদের যুগ পড়িয়াছে তাই বিচ্ছেদ, বৈষম্য। যখন ঐক্যের যুগ আসিবে তখন এই বৃহৎ স্তুপের মধ্যে অনেক ঝরিয়া গিয়া, পরিপাক প্রাপ্ত হইয়া একখানি সমগ্ৰ সুন্দর সভ্যতা দাড়াইয়া যাইবে । ক্ষুদ্র পরিণামের মধ্যে পরিসমাপ্তি লাভ করিয়া সন্তুষ্টভাবে থাকার মধ্যে একটি শান্তি সৌন্দর্য ও নিৰ্ভয়তা আছে সন্দেহ নাই— আর, যাহারা মনুষ্যপ্রকৃতিকে ক্ষুদ্র ঐক্য হইতে মুক্তি দিয়া বিপুল বিস্তারের দিকে লইয়া যায় তাহারা অনেক অশান্তি অনেক বিঘ্নবিপদ সহ্য করে, বিপ্লবের রণক্ষেত্রের মধ্যে তাহাদিগকে অশ্রান্ত সংগ্ৰাম করিতে হয়, কিন্তু তাহারাই পৃথিবীর মধ্যে বীর এবং তাহারা যুদ্ধে পতিত হইলেও অক্ষয় স্বৰ্গ লাভ করে । এই বীর্য এবং সৌন্দর্যের মিলনেই যথার্থ সম্পূর্ণতা । উভয়ের বিচ্ছেদে অর্ধসভ্যতা । তথাপি আমরা সাহস করিয়া যুরোপকে অর্ধসভ্য বলি না, বলিলেও কাহারও গায়ে বাজে না । যুরোপ আমাদিগকে অর্ধসভা বলে এবং বলিলে আমাদের গায়ে বাজে, কারণ সে আমাদের কর্ণধার হইয়া বসিয়াছে । আমি এই পল্লীপ্রান্তে বসিয়া আমার সাদাসিধা তানপুরার চারটি তারের গুটিচারেক সুন্দর সুরসম্মিশ্রণের সহিত মিলাইয়া যুরোপীয় সভ্যতাকে বলিতেছি “তোমার সুর এখনো ঠিক মিলিল না।” এবং তানপুরাটিকেও বলিতে হয়, “তোমার ঐ গুটিকয়েক সুরের পুনঃপুনঃ ঝংকারকেও পরিপূর্ণ সংগীত জ্ঞান করিয়া সন্তুষ্ট হওয়া যায় না । বরঞ্চ আজিকার ঐ বিচিত্র বিশৃঙ্খল স্বরসমষ্টি কাল প্ৰতিভার প্রভাবে মহাসংগীতে পরিণত হইয়া উঠিতে পারে, কিন্তু হায়, তোমার ঐ কয়েকটি তারের মধ্য হইতে মহৎ মূর্তিমান সংগীত বাহির করা প্রতিভার পক্ষেও দুঃসাধ্য।’ আশ্বিন-কার্তিক ১৩০০ মনীষা স্রোতস্বিনী প্ৰাতঃকালে আমার বৃহৎ খাতাটি হাতে করিয়া আনিয়া কহিল—এ-সব তুমি কী লিখিয়াছ ! আমি যে-সকল কথা কস্মিনকালে বলি নাই তুমি আমার মুখে কেন বসাইয়াছ ? আমি কহিলাম- তাহাতে দোষ কী হইয়াছে ? স্রোতস্বিনী কহিল— এমন করিয়া আমি কখনো কথা কহি না এবং কহিতে পারি না। যদি তুমি আমার মুখে এমন কথা দিতে, যাহা আমি বলি বা না বলি আমার পক্ষে বলা সম্ভব, তাহা হইলে আমি এমন লজ্জিত হইতাম না । কিন্তু এ যেন তুমি একখানা বই লিখিয়া আমার নামে চালাইতেছ। আমি কহিলাম— তুমি আমাদের কাছে কতটা বলিয়াছ তাহা তুমি কী করিয়া বুঝিবে । তুমি যতটা বল, তাহার সহিত, তোমাকে যতটা জানি, দুই মিশিয়া অনেকখানি হইয়া উঠে । তোমার সমস্ত জীবনের দ্বারা তোমার কথাগুলি ভরিয়া উঠে । তোমার সেই অব্যক্ত উহ্য কথাগুলি তো বাদ দিতে °ड़िी नां । স্রোতস্বিনী চুপ করিয়া রহিল। জানি না, বুঝিল কি না-বুঝিল । বােধ হয় বুঝিল, কিন্তু তথাপি