পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৯৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পঞ্চভূত S RGł বলিতে বলিতে স্বপ্নাবিষ্ট শূন্যদৃষ্টি ব্যোম উৎফুল্ল হইয়া উঠিল, চৌকিতে সরল হইয়া উঠিয়া বসিয়া কহিল- যদি এমনভাবে দেখো, তবে প্রত্যেক মানুষের মধ্যে একটা অনন্তকালীন প্ৰেমাভিনয় দেখিতে পাইবে । জীব তাহার মূঢ় অবোধ নির্ভরপরায়ণা সঙ্গিনীটিকে কেমন করিয়া পাগল করিতেছে দেখো । দেহের প্রত্যেক পরমাণুর মধ্যে এমন একটি আকাঙক্ষার সঞ্চার করিয়া দিতেছে, দেহধর্মের দ্বারা যে আকাঙক্ষার পরিতৃপ্তি নাই। তাহার চক্ষে যে সৌন্দৰ্য আনিয়া দিতেছে, দৃষ্টিশক্তির দ্বারা তাহার সীমা পাওয়া যায় না, তাই সে বলিতেছে “জনম অবধি হম রূপ নেহারানু নয়ন না। তিরপিত ভেল' ; তাহার কৰ্ণে যে সংগীত আনিয়া দিতেছে শ্রবণশক্তির দ্বারা তাহার আয়ত্ত হইতে পারে না, তাই সে ব্যাকুল হইয়া বলিতেছে ‘সোই মধুর বোল শ্রবণহি শুনলু। শ্রতিপথে পরশ না গেল । আবার এই প্ৰাণপ্ৰদীপ্ত মৃঢ় সঙ্গিনীটিও লতার ন্যায় সহস্ৰ শাখাপ্রশাখা বিস্তার করিয়া প্রেমপ্রতপ্ত সুকোমল আলিঙ্গনপাশে জীবকে আচ্ছন্ন প্রচ্ছন্ন করিয়া ধরে ; অল্পে অল্পে তাহাকে মুগ্ধ করিয়া আনে ; অশ্রান্ত যত্নে ছায়ার মতো সঙ্গে থাকিয়া বিবিধ উপচারে তাহার সেবা করে ; প্রবাসকে যাহাতে প্ৰবাস জ্ঞান না হয়, যাহাতে আতিথ্যের ত্রুটি না হইতে পারে, সেজন্য সর্বদাই সে তাহার চক্ষুকৰ্ণহস্তপদকে সতর্ক করিয়া রাখে । এত ভালোবাসার পরে তবু একদিন জীব এই চিরানুগতা অনন্যাসক্তা দেহলতাকে ধূলিশায়িনী করিয়া দিয়া চলিয়া যায়। বলে, প্ৰিয়ে, তোমাকে আমি আত্মনির্বিশেষে ভালোবাসি, তবু আমি কেবল একটি দীর্ঘনিশ্বাসমােত্র ফেলিয়া তোমাকে ত্যাগ করিয়া যাইব । কায়া তখন তাহার চরণ জড়াইয়া বলে, বন্ধু, তোমার প্রেমে কেন আমাকে এমন মহিমাশালিনী করিয়া তুলিয়াছিলে ? হায়, আমি তোমার যোগ্য নই, কিন্তু তুমি কেন আমার এই প্ৰাণপ্ৰদীপ্ত নিভৃত সোনার মন্দিরে একদা রহস্যান্ধকার নিশীথে অনন্ত সমুদ্র পার হইয়া অভিসারে আসিয়াছিলে ? আমার কোন গুণে তোমাকে মুগ্ধ করিয়াছিলাম ? এই করুণ প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়া এই বিদেশী কোথায় চলিয়া যায় তাহা কেহ জানে না । সেই আজন্মমিলনবন্ধনের অবসান, সেই মাথুরযাত্রার বিদায়ের দিন, সেই কায়ার সহিত কায়াধিরাজের শেষ সম্ভাষণ, তাহার মতো এমন শোচনীয় বিরহদৃশ্য কোন প্রেমকাব্যে বর্ণিত আছে! ক্ষিতির মুখভাব হইতে একটা আসন্ন পরিহাসের আশঙ্কা করিয়া ব্যোম কহিল— তোমরা ইহাকে প্রেম বলিয়া মনে কর না ; মনে করিতেছ। আমি কেবল রূপক-অবলম্বনে কথা কহিতেছি। তাহা নহে । জগতে ইহাই সর্বপ্রথম প্ৰেম এবং জীবনের সর্বপ্রথম প্ৰেম সর্বাপেক্ষা যেমন প্রবল হইয়া থাকে জগতের সর্বপ্রথম প্রেমও সেইরূপ সরল অথচ সেইরূপ প্ৰবল ৷ এই আদিগ্ৰেপ্ৰম, এই দেহের ভালোবাসা, যখন সংসারে দেখা দিয়াছিল তখনো পৃথিবীতে জলে স্থলে বিভাগ হয় নাই। সেদিন কোনো কবি উপস্থিত ছিল না, কোনো ঐতিহাসিক জন্মগ্রহণ করে নাই, কিন্তু সেইদিন এই জলময় পঙ্কময় অপরিণত ধরাতলে প্ৰথম ঘোষিত হইল যে, এ জগৎ যন্ত্রজগৎমাত্র নহে ; প্ৰেম-নামক এক অনির্বাচনীয় আনন্দময় বেদনাময় ক্তি পঙ্কের মধ্য হইতে পঙ্কজবন জাগ্ৰত করিয়া তুলিতেছেন, এবং সেই পঙ্কজবনের উপরে আজ ভক্তের চক্ষে সৌন্দর্যরূপ লক্ষ্মী এবং ভাবরূপা সরস্বতীর অধিষ্ঠান । হইয়াছে । ক্ষিতি কহিল— আমাদের প্রত্যেকের ভিতরে যে এমন একটা বৃহৎ কাব্যাকাণ্ড চলিতেছে শুনিয়া পুলকিত হইলাম, কিন্তু সরলা কায়াটির প্রতি চঞ্চলস্বভাব আত্মাটার ব্যবহার সন্তোষজনক নহে। ইহা স্বীকার করিতেই হইবে । আমি একান্তমনে আশা করি যেন আমার জীবাত্মা এরূপ চপলতা প্ৰকাশ না। করিয়া অন্তত কিছু দীর্ঘকাল দেহ-দেবযানীর আশ্রমে স্থায়ীভাবে বাস করে । তোমরাও সেই আশীৰ্বাদ করে । সমীর কহিল— ভ্রাতঃ ব্যোম, তোমার মুখে তো কখনো শাস্ত্ৰবিরুদ্ধ কথা শুনি নাই। তুমি কেন আজ এমন খৃস্টানের মতো কথা কহিলে ? জীবাত্মা স্বৰ্গ হইতে সংসারাশ্রমে প্রেরিত হইয়া দেহের সঙ্গলাভ করিয়া সুখদুঃখের মধ্য দিয়া পরিণতি প্রাপ্ত হইতেছে, এ-সকল মত তো তোমার পূর্বমতের সহিত মিলিতেছে না ।