পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8Qぐう রবীন্দ্র-রচনাবলী অনেক বড়ো কাজ করেছে, সে-সমস্তই একেবারে মিথ্যা হয়ে গেছে এ কথা কল্পনা করাও সত্যের প্রতি অশ্রদ্ধা— সেই তো নাস্তিকতা ।” স্বচরিত মুখ নিচু করিয়া শুনিতেছিল। সে মুখ তুলিয়া কহিল, “আপনি আমাকে কী করতে বলেন ?” গোরা কহিল, “আর-কিছু বলি নে— আমি কেবল বলি আপনাকে এই কথাটা বুঝে দেখতে হবে যে হিন্দুধর্ম মায়ের মতো নানা ভাবের নানা মতের লোককে কোল দেবার চেষ্টা করেছে ; অর্থাং কেবল হিন্দুধর্মই জগতে মানুষকে মানুষ বলেই স্বীকার করেছে, দলের লোক বলে গণ্য করে নি । হিন্দুধর্ম মূঢ়কেও মানে, জ্ঞানীকেও মানে ; এবং কেবলমাত্র জ্ঞানের এক মূর্তিকেই মানে না, জ্ঞানের বহু প্রকার বিকাশকে মানে । খৃস্টানরা বৈচিত্র্যকে স্বীকার করতে চায় না ; তারা বলে এক পারে খৃস্টানধৰ্ম আরএক পারে অনন্ত বিনাশ, এর মাঝখানে কোনো বিচিত্রতা নেই । আমরা সেই খৃস্টানের কাছ থেকেই পাঠ নিয়েছি, তাই হিন্দুধর্মের বৈচিত্র্যের জন্তে লজ্জা পাই । এই বৈচিত্র্যের ভিতর দিয়েই হিন্দুধর্ম যে এককে দেখবার জন্তে সাধনা করছে সেটা আমরা দেখতে পাই নে । এই খৃস্টানি শিক্ষার পাক মনের চারি দিক থেকে খুলে ফেলে মুক্তিলাভ না করলে আমরা হিন্দুধর্মের সত্যপরিচয় পেয়ে গৌরবের অধিকারী হব না ।” কেবল গোরার কথা শোনা নহে, স্বচরিতা যেন গোরার কথা সম্মুখে দেখিতেছিল, গোরার চোখের মধ্যে দূর-ভৰিষাং-নিবন্ধ যে-একটি ধ্যানদৃষ্টি ছিল সেই দৃষ্টি এবং বাক্য সুচরিতার কাছে এক হইয়া দেখা দিল । লজ্জা ভুলিয়া, আপনাকে ভুলিয়া, ভাবের উৎসাহে উদ্দীপ্ত গোরার মুখের দিকে স্বচরিতা চোখ তুলিয়া চাহিয়া রছিল। এই মুখের মধ্যে স্বচরিতা এমন একটি শক্তি দেখিল যে শক্তি পৃথিবীতে বড়ে বড়ো ংকল্পকে যেন যোগবলে সত্য করিয়া তোলে। স্বচরিতা তাহার সমাজের অনেক বিদ্বান ও বুদ্ধিমান লোকের কাছে অনেক তত্ত্বালোচনা শুনিয়াছে, কিন্তু গোরার এ তো আলোচনা নহে, এ যেন স্বষ্টি । ইহা এমন একটা প্রত্যক্ষ ব্যাপার যাহা এক কালে সমস্ত শরীর মনকে অধিকার করিয়া বলে । স্বচরিতা আজ বজ্রপাণি ইন্দ্রকে দেখিতে ছিল— বাক্য যখন প্রবলমন্দ্রে কর্ণে আঘাত করিয়া তাহার বক্ষঃকপাটকে স্পদিত করিতেছিল সেই সঙ্গে বিদ্যুতের তীব্রচ্ছটা তাহার রক্তের মধ্যে ক্ষণে ক্ষণে নৃত্য করিয়া উঠিতেছিল। গোরার মতের সঙ্গে তাহার মতের কোথায় কী পরিমাণ মিল আছে বা মিল নাই তাহা স্পষ্ট করিয়া দেখিবার শক্তি স্বচরিতার রহিল না । এমন সময় সতীশ ঘরে প্রবেশ করিল। গোরাকে সে ভয় করিত— তাই তাহাকে