পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৪৩০ রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী শমিলা স্বামীর কাপড় ধরে টেনে বসিয়ে বললে, “আমিও যে তোমারই ।” । তার পর বললে, “বের করো তোমার জেব থেকে ফাউন্টেনপেন, এই নাও চিঠির কাগজ, লেখে। রেজিগনেশন-পত্র। সেটা ডাকে রওনা না করে আমার শান্তি নেই।” “আমারও শান্তি নেই বোধ হচ্ছে ।” 糖 লিখলে রেজিগনেশন-পত্ৰ । পরদিনই শর্মিলা চলে গেল। কলকাতায়, উঠল গিয়ে মথুরদাদার বাড়িতে । অভিমান করে বললে, “একদিনও তো বোনের খবর নাও না ।” . মেয়ে-প্রতিদ্বন্দ্বী হলে বলত, “তুমিও তো নাও না।” পুরুষের মাথায় সে জবাব জোগাল না। অপরাধ মেনে নিলে। বললে, “নিশ্বাস ফেলবার কি সময় আছে। নিজে আছি কি না। তাই ভুল হয়ে যায়। আর, তা ছাড়া তোমরাও তো দূরে দূরে বেড়াও ” শর্মিলা বললে, “কাগজে দেখলুম। ময়ুরভঞ্জ না মথুরগঞ্জ কোথায় একটা ব্রিজ তৈরির কাজ পেয়েছ। পড়ে এত খুশি হলুম। তখনই মনে হল মথুরদাদাকে নিজে গিয়ে কনগ্রাচুলেট করে আসি।” “একটু সবুর কোরো খুকি। এখনো সময় হয় নি।” ব্যাপারখানা। এই : নগদ টাকা ফেলার দরকার । মাড়োয়ারি ধনীর সঙ্গে ভাগে কাজ করার কথা । শেষকালে প্ৰকাশ হল, যেরকম শর্ত তাতে শাসের ভাগটাই মাড়োয়ারির আর ছিবড়ের ভাগটাই পড়বে ওর কপালে। তাই পিছোবার চেষ্টা । । শমিলা ব্যস্ত হয়ে উঠে বললে, “এ কখনো হতেই পারে না । ভাগে কাজ করতে যদি হয় আমাদের সঙ্গে করো। এমন কাজটা তোমার হাত থেকে ফসকে গেলে ভারি অন্যায় হবে। আমি থাকতে এ হতেই দেব না, যাই বল তুমি ।” - এর পরে লেখাপড়া হতেও দেরি হল না ; মথুরদাদার হৃদয়ও বিগলিত হল। ব্যাবসা চলল বেগে । এর আগে চাকরির দায়িত্বে শশাঙ্ক কাজ করেছে, সে দায়িত্বের সীমা ছিল পরিমিত । মনিব ছিল নিজের বাইরে, দাবি এবং দেয় সমান সমান ওজন মিলিয়ে চলত। এখন নিজেরই প্ৰভুত্ব নিজেকে চালায়। দাবি এবং দেয় এক জায়গায় মিলে গেছে। দিনগুলো ছুটিতে কাজেতে জাল-বোনা নয়, সময়টা হয়েছে নিরেট । যে দায়িত্ব ওর মনের উপর চেপে, সেটাকে ইচ্ছে করলেই ত্যাগ করা যায় বলেই তার জোর এত কড়া। আর কিছু নয়, স্ত্রীর ঋণ শুধতেই হবে, তার পরে ধীরে সুস্থে চলাবার সময় পাওয়া যাবে। বা হাতের কজিতে ঘড়ি, মাথায় সোলার টুপি, আস্তিন গোটানো, খাকির প্যান্ট পরা, চামড়ার কোমরবন্ধ আঁটা, মোটা-সুকতলা-ওআলা জুতো, চোখে রোদ বঁাচাবার রঙিন চশমা- শশাঙ্ক উঠেপড়ে লেগে গেল। কাজে । স্ত্রীর ঋণ যখন শোধ হবার কিনারায় এল তখনাে ইস্টিমের দম কমায় না, মনটা তখন উঠেছে। গরম হয়ে । । ইতিপূর্বে সংসারে আয়ব্যয়ের ধারাটা বইত একই খাদে, এখন হল দুই শাখা । একটা গেল ব্যাঙ্কের দিকে, আর-একটা ঘরের দিকে। শৰ্মিলার বরাদ্দ পূর্বের মতোই আছে, সেখানকার দেনাপাওনার রহস্য শশাঙ্কর অগোচরে । আবার ব্যবসায়ের ঐ চামড়া-বাধানো হিসেবের খাতাটা শৰ্মিলার পক্ষে দুৰ্গম দুৰ্গবিশেষ। তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু স্বামীর ব্যবসায়িক জীবনের কক্ষপথ ওর সংসারচক্রের বাইরে পড়ে যাওয়াতে সেই দিক থেকে ওর বিধিবিধান উপেক্ষিত হতে থাকে। মিনতি করে বলে, “বাড়াবাড়ি কোরো না, শরীর যাবে ভেঙে ।” কোনো ফল হয় না। আশ্চর্য এই, শরীরও ভাঙছে না। স্বাস্থ্য নিয়ে উদবেগ, বিশ্রামের অভাব নিয়ে আক্ষেপ, আরামের খুঁটিনাটি নিয়ে ব্যস্ততা ইত্যাদি শ্রেণীর দাম্পত্যিক উৎকণ্ঠা সবেগে উপেক্ষা করে শশাঙ্ক সকালবেলায় সেকেন্দ্রাহ্যান্ড ফোর্ডগাড়ি নিজে হাঁকিয়ে শির্ডে বাজিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বেলা দুটাে-আড়াইটার সময় ঘরে ফিরে এসে বকুনি খায়, এবং আর-আর খাওয়াও দ্রুত হাত চালিয়ে শেষ করে । একদিন ওর মােটরগাড়ির সঙ্গে আর-কার গাড়ির ধাক্কা লাগল। নিজে গেল বেঁচে, গাড়িটা হল