পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দুই বোন। 88. “আমার ভারি ভালো লাগে, দিদি ৷” শর্মিলা অবিশ্বাসের সুরে বললে, “হীঃ ভালো লাগে ! ওকে খুশি করবার জন্যই দেখাস যেন ভালো লাগে৷ ” নাহয় তাই হল। খাওয়ানাে-পরানাে সেবা-যত্নে শশাঙ্ককে খুশি করাটা তো শৰ্মিলার মনঃপূত । কিন্তু এই জাতের খুশিটা ওর নিজের খুশির জাতের সঙ্গে মেলে না । শশাঙ্ককে বার বার ডেকে বলে, “ওকে নিয়ে সময় নষ্ট কর কেন ? ওতে যে তোমার কাজের ক্ষতি হয়। ও ছেলেমানুষ, এ-সব কী বুঝবে ?” শশাঙ্ক বলে, “আমার চেয়ে কম বোঝে না ।” মনে করে এই প্রশংসায় দিদিকে বুঝি আনন্দ দেওয়াই হল। নির্বোিধ ! নিজের কাজের গৌরবে শশাঙ্ক যখন আপনি স্ত্রীর প্রতি মনোযোগকে খাটো করেছিল তখন শমিলা সেটা যে শুধু অগত্যা মেনে নিয়েছিল তা নয়, তাতে সে গর্ব বোধ করত। তাই, ইদানীং আপন সেবাপরায়ণ হৃদয়ের দাবি অনেক পরিমাণেই কমিয়ে এনেছে। ও বলত, পুরুষমানুষ রাজার জাত, দুঃসাধ্য কর্মের অধিকার ওদের নিয়তই প্রশস্ত করতে হবে । নইলে তারা মেয়েদের চেয়েও নিচু হয়ে যায়। কেননা, মেয়েরা আপন স্বাভাবিক মাধুৰ্যে, ভালোবাসার জন্মগত ঐশ্বর্যেই, সংসারে প্রতিদিন আপন আসনকে সহজেই সার্থক করে। কিন্তু পুরুষের নিজেকে সার্থক করতে হয় প্রত্যহ যুদ্ধের । দ্বারা । সে কালে রাজারা বিনা প্রয়োজনেই রাজ্যবিস্তার করতে বেরোত । রাজ্যলোভের জন্যে নয়, নূতন করে পৌরুষের গৌরব প্রমাণের জন্যে। এই গীেরবে মেয়েরা যেন বাধা না দেয়। শৰ্মিলা বাধা দেয় নি, ইচ্ছা করেই শশাঙ্ককে তার লক্ষ্য-সাধনায় সম্পূর্ণ পথ ছেড়ে দিয়েছে। এক সময়ে তাকে ওর সেবাজালে জড়িয়ে ফেলেছিল, মনে দুঃখ পেলেও সেই জলকে ক্রমশ খর্ব করে এনেছে। এখনো সেবা যথেষ্ট করে, অদৃশ্যে, নেপথ্যে । হায় রে, আজ ওর স্বামীর এ কী পরাভব দিনে দিনে প্রকাশ হয়ে পড়ছে। রোগশয্যা থেকে সব ও দেখতে পায় না, কিন্তু যথেষ্ট আভাস পায়। শশাঙ্কের মুখ দেখলেই বুঝতে পারে, সে যেন সর্বদাই । কেমন আবিষ্ট হয়ে আছে । ঐ একরাত্তি মেয়েটা এসে অল্প এই কদিনেই এত বড়ো সাধনার আসন । থেকে ঐ কর্মকঠিন পুরুষকে বিচলিত করে দিলে। আজ স্বামীর এই অশ্রদ্ধয়তা শৰ্মিলাকে রোগের বেদনার চেয়েও বেশি করে বাজছে । শশাঙ্কের আহারবিহার বেশবাসের চিরাচরিত ব্যবস্থায় নানারকম ক্ৰটি হচ্ছে সন্দেহ নেই । যে পথ্যটা তার বিশেষ রুচিকর সেটাই খাবার সময় হঠাৎ দেখা যায় অবর্তমান । তার কৈফিয়ত মেলে, কিন্তু কোনো কৈফিয়তকে এ সংসার এত দিন আমল দেয় নি । এ-সব অনবধানতা ছিল অমার্জনীয়, কঠোর শাসনের যোগ্য ; সেই বিধিবদ্ধ সংসারে আজ এত বড়ো যুগান্তর ঘটেছে যে, গুরুতর ত্রুটিগুলোও প্রহসনের মতো হয়ে উঠল। দোষ দেবে কাকে ! দিদির নির্দেশমত উমি যখন রান্নাঘরে বেতের মোড়ার উপর বসে পাকপ্ৰণালীর পরিচালনকার্যে নিযুক্ত, সঙ্গে সঙ্গে পাচক-ঠাকরুনের পূর্বজীবনের বিবরণগুলির পর্যালোচনাও চলছে, এমন সময় শশাঙ্ক হঠাৎ এসে বলে, “ও-সব এখন থাক ।” । “কেন, কী করতে হবে ?” “আমার এ বেলা ছুটি আছে, চলো, ভিক্টেরিয়া মেমোরিয়ালের বিলডিংটা দেখবে। ওটার গুমর দেখলে হাসি পায় কেন তোমাকে বুঝিয়ে দেব ।” এত বড়ো প্রলোভনে কর্তব্যে ফাকি দিতে উৰ্মির মনও তৎক্ষণাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে। শৰ্মিলা জানে পাকশালা থেকে তার সহােদরার অন্তর্ধানে আহার্যের উৎকর্ষ সাধনে কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না, তবু স্নিগ্ধ হৃদয়ের যত্নটুকু শশাঙ্কের আরামকে অলংকৃত করে। কিন্তু আরামের কথা তুলে কী হবে যখন প্রতিদিনই স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে আরামটা সামান্য হয়ে গেছে, স্বামী হয়েছে খুশি। এই দিক থেকে শর্মিলার মনে এল অশান্তি । রোগশয্যায়। এ-পাশ ও-পাশ ফিরতে ফিরতে নিজেকে