পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দুই বােন 866 চার্লি চ্যাপলিনের নাম, ফল হয় না কিছুই। উর্মি যখন দুর্লভ ছিল না তখনো বাধার ভিতর দিয়ে শশাঙ্ক কাজকর্ম চালাতে চেষ্টা করত । এখন অসম্ভব হয়ে এল। হতভাগার এই নিরর্থক নিপীড়নে প্রথম প্রথম শৰ্মিলা বড়ো দুঃখেও সুখ পেত। কিন্তু ক্ৰমে দেখলে ওর যন্ত্রণা উঠছে প্রবল হয়ে, মুখ গেছে শুকিয়ে, চোখের নীচে পড়ছে। কালি । উর্মি খাওয়ার সময় কাছে বসে না, সেজন্য শশাঙ্কর খাওয়ার উৎসাহ এবং পরিমাণ কমে যাচ্ছে তা। ওকে দেখলে বোঝা যায়। সম্প্রতি হঠাৎ এ বাড়িতে আনন্দের যে বান ডেকে এসেছিল সেটা গেছে সম্পূর্ণ ভঁটিয়ে, অথচ পূর্বে ওদের যে একটা সহজ দিনযাত্রা ছিল সেও রইল না। একদা শশাঙ্ক নিজের চেহারার চর্চায় উদাসীন ছিল । নাপিতকে দিয়ে চুল ছাঁটাত প্ৰায় ন্যাড়া করে । আঁচড়াবার প্রয়োজন ঠেকেছিল সিকির সিকিতে । শৰ্মিলা তাই নিয়ে অনেকবার প্রবল বাগবিতণ্ডা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু ইদানীং উর্মির উচ্চহাস্যসংযুক্ত সংক্ষিপ্ত আপত্তি নিম্বফল হয় নি। নূতন সংস্করণের কেশোদগমের সঙ্গে সুগন্ধি তৈলের সংযোগসাধন শশাঙ্কর মাথায় এই প্রথম ঘটল । কিন্তু তার পর আজকাল কেশোল্পতিবিধানের অনাদরেই ধরা পড়ছে। অন্তরবেদনা। এতটা বেশি যে, এ নিয়ে প্রকাশ্য বা অপ্ৰকাশ্য তীব্ৰ হাসি আর চলে না । শৰ্মিলার উৎকণ্ঠা তার ক্ষোভকে ছাড়িয়ে গেল । স্বামীর প্রতি করুণায় ও নিজের প্রতি ধিককারে তার বুকের মধ্যে টনটন করে উঠছে, রোগের ব্যাথাকে দিচ্ছে এগিয়ে । ময়দানে হবে কেল্লার ফৌজদের যুদ্ধের খেলা। শশাঙ্ক ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করতে এল, “যাবে উর্মি, দেখতে ? ভালো জায়গা ঠিক করে রেখেছি।” উর্মি কোনো উত্তর দেবার পূর্বেই শর্মিলা বলে উঠল, “যাবে বৈকি। নিশ্চয় যাবে। একটু বাইরে ঘুরে আসবার জন্যে ও যে ছটফট করছে।” প্রশ্রয় পেয়ে দুদিন না যেতেই জিজ্ঞাসা করলে, “সার্কাস ?” এ প্ৰস্তাবে উমিমালার উৎসাহই দেখা গেল । এইটােতে একটু বাধল। দিদিকে ফেলে বেশিক্ষণ দূরে থাকতে উর্মির মন সায় দিচ্ছে না। দিদি স্বয়ং পক্ষ নিল শশাঙ্কর । রাজ্যের রাজমজুরদের সঙ্গে দিনে দুপুরে ঘুরে ঘুরে খেটে খেটে মানুষটা যে হয়রান হল- সারা দিন কেবল খাটছে ধুলোবালির মধ্যে । হাওয়া না খেয়ে এলে শরীর GRN PRVGK (SENS || এই একই যুক্তি অনুসারে স্টীমারে করে রাজগঞ্জ পর্যন্ত ঘুরে আসা অসংগত হল না। শৰ্মিলা মনে মনে বলে, যার জন্যে কাজ খোওয়াতে ওর ভাবনা নেই তাকে সুদ্ধ খোওয়ানো ওর সইবে না । শশাঙ্ককে স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলে নি বটে, কিন্তু চারি দিক থেকেই সে একটা অব্যক্ত সমর্থন পাচ্ছে। শশাঙ্ক একরকম ঠিক করে নিয়েছে, শর্মিলার মনে বিশেষ কোনো ব্যথা নেই, ওদের দুজনকে একত্র মিলিয়ে খুশি দেখেই সে খুশি । সাধারণ মেয়ের পক্ষে এটা সম্ভব হতে পারত না, কিন্তু শৰ্মিলা যে অসাধারণ। শশাঙ্কর চাকরির আমলে একজন আর্টিস্ট রঙিন পেনসিল দিয়ে শৰ্মিলার একটা ছবি এঁকেছিল। এত দিন সেটা ছিল পোর্টফোলিয়ের মধ্যে। সেইটােকে বের করে বিলিতি দোকানে খুব দামি ফ্যাশানে বঁধিয়ে নিয়ে আপিস-ঘরে যেখানে বসে ঠিক তার সমুখে দেয়ালে বুলিয়ে রাখলে। সামনের ফুলদানিতে রোজ মালী ফুল দিয়ে যায়। অবশেষে একদিন শশাঙ্ক বাগানে সূর্যমুখী কিরকম ফুটছে দেখাতে দেখাতে হঠাৎ উর্মির হাত চেপে ধরে বললে, “তুমি নিশ্চয় জান, তোমাকে আমি ভালোবাসি ; আর, তোমার দিদি, তিনি তো দেবী। তঁাকে যত ভক্তি করি জীবনে আর-কাউকে তেমন করি নে। তিনি পৃথিবীর মানুষ নন, তিনি আমাদের অনেক উপরে ।”