পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শব্দতত্ত্ব । VVS) গদ্য ও পদ্যের প্রভেদও এই কারণমূলক । গদ্য জ্ঞান লইয়া এবং পদ্য অনুভব লইয়া। বিশুদ্ধ জ্ঞান অর্থের সাহায্যে পরিস্ফুট হয় ; কিন্তু অনুভব কেবলমাত্র অর্থের দ্বারা ব্যক্ত হয় না, তাহার জন্য ছন্দের ধ্বনি চাই ; সেই ধ্বনি অনির্বাচনীয়কে সংকেতে প্ৰকাশ করে । আমাদের বর্ণনায় যে-অংশ অপেক্ষাকৃত অনির্বাচনীয়তর, সেইগুলিকে ব্যক্ত করিবার জন্য বাংলাভাষায় এই সকল অভিধানের আশ্রয়চ্যুত অব্যক্ত ধ্বনি কাজ করে । যাহা চঞ্চল, যাহার বিশেষত্ব অতি সূক্ষ্ম, যাহার অনুভূতি সহজে সুস্পষ্ট হইবার নহে, তাহাদের জন্য এই ধ্বনিগুলি সংকেতের কাজ করিতেছে । আমার তালিকা অকারাদি বর্ণানুক্রমে লিপিবদ্ধ করিয়াছি। সময়াভাব্যবশত সেই সহজ পথ লইয়াছি। উচিত ছিল চলন কর্তন পতন প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে শব্দগুলিকে শ্রেণীবদ্ধ করা। তাহা হইলে সহজে বুঝা যাইত, কোন কোন শ্রেণীর বর্ণনায় এই শব্দগুলি ব্যবহার হয় এবং ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে ধ্বনির ঐক্য আছে কি না । ঐক্য থাকাই সম্ভব । ছেদনবোধক শব্দগুলি চকারান্ত অথবা টকারান্ত ; কচ এবং কীট- তীক্ষ অন্ত্রে ছেদন কচ, এবং গুরু অস্ত্ৰে কট। এই পর্যায়ের সকল শব্দই ক-বাগের মধ্যে সমাপ্ত ; কঁ্যাচ খ্যাচ গ্যাচ ধর্য্যাচ । | - পাঠকগণ চেষ্টা করিয়া এইরূপ পৰ্যায়বিভাগে সহায়তা করিবেন। এই আশা করি । ভাবসা বুপসি ঢাপসা হোৎকা গোমসা ধুমসো ঘুপসি, মটকা মারা, ওঁড়ি মারা, উকি মারা, টেবো, ট্যাবলা, ভেবড়ে যাওয়া, মুষড়ে যাওয়া প্রভৃতি বর্ণনামূলক খাটি বাংলাশব্দের শ্রেণীবদ্ধ তালিকাসংকলনে পাঠকদিগকে অনুরোধ করিয়া প্ৰবন্ধের উপসংহার করি । Swo বাংলা কৃৎ ও তদ্ধিত প্ৰবন্ধ-আরম্ভে বলা আবশ্যক যে-সকল বাংলা শব্দ লইয়া আলোচনা করিব, তাহার বানান কলিকাতার উচ্চারণ অনুসারে লিখিত হইবে। বর্তমানকালে কলিকাতা ছাড়া বাংলাদেশের অপরাপর বিভাগের উচ্চারণকে প্ৰাদেশিক বলিয়া গণ্য করাই সংগত । আজ পর্যন্ত বাংলা-অভিধান বাহির হয় নাই ; সুতরাং বাংলাশব্দের দৃষ্টান্ত সংগ্ৰহ করিতে নিজের অসহায় স্মৃতিশক্তির আশ্ৰয় লইতে হয়। কিন্তু স্মৃতির উপর নির্ভর করিবার দোষ এই যে, স্মৃতি অনেক সময় অযাচিত অনুগ্রহ করে, কিন্তু প্ৰাখীর প্রতি বিমুখ হইয়া দাঁড়ায় । সেই কারণে প্রবন্ধে পদে পদে অসম্পূর্ণতা থাকিবে। আমি কেবল বিষয়টার সূত্রপাত করিবার ভার লইলাম, তাহা সম্পূর্ণ করিবার ভার সুধীসাধারণের উপর। আমার পক্ষে সংকোচের আর-একটি গুরুতর কারণ আছে। আমি বৈয়াকরণ নাহি । অনুরাগ্যবশত বাংলাশব্দ লইয়া অনেক দিন ধরিয়া অনেক নাড়াচাড়া করিয়াছি ; কখনো কখনো বাংলার দুটা-একটা ভাষাতত্ত্ব মাথায় আসিয়াছে ; কিন্তু ব্যাকরণব্যবসায়ী নহি বলিয়া সেগুলিকে যথাযোগ্য পরিভাষার সাহায্যে সাজাইয়া লিপিবদ্ধ করিতে সাহসী হই নাই। এ প্রবন্ধে পাঠকেরা আনাড়ির পরিচয় পাইবেন, কিন্তু চেষ্টা ও পরিশ্রমের ত্রুটি দেখিতে পাইবেন না । অতএব শ্রমের দ্বারা যাহা সংগ্ৰহ করিয়াছি, পণ্ডিতগণের বিদ্যাবুদ্ধির দ্বারা তাহা সংশোধিত হইবে আশা করিয়াই সাহিত্য-পরিষদে এই বাংলাভাষাতত্ত্বঘটিত প্রবন্ধের অবতারণা করিলাম। : w সংস্কৃত ব্যাকরণের পরিভাষা রাংলা ব্যাকরণে প্রয়োগ করা কিরূপ বিপজ্জনক তাহা মহামহােপাধ্যায় হাশয় ইতিপূর্বে ব্যাখ্যা করিয়াছেন।” সুতরাং জ্ঞাতসারে পাপ করিতে প্রবৃত্তি হয় না। নূতন ১ বাংলা ব্যাকরণ— হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ; সাহিত্য-পরিষৎ-পত্রিকা ১৩০৮, প্রথম সংখ্যা । A