পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Lviv রবীন্দ্র-রচনাবলী মাটির মানুষ দেখা যায় না। । আরো এমন ব্যক্তিগত দৃষ্টান্ত অনেক আছে, কিন্তু সেগুলিকে প্রমাণস্বরূপে উল্লেখ করিয়া ফল কী। চন্দ্রনাথবাবুর বিবেচনা করিয়া দেখা উচিত এরূপ ব্যক্তিগত দৃষ্টান্ত প্রমাণস্বরূপে প্রয়োগ করিলে বুঝায় যে, তাহার মতে অন্যপক্ষে একজনও বলিষ্ঠ এবং নির্মলপ্ৰকৃতির লোক নাই । আধুনিক শিক্ষিত যুবকদের প্রতি চন্দ্রনাথবাবুর অভিযোগ এই যে : তাহারা অসংযতেন্দ্ৰিয়, তাহাদের সংযমশিক্ষা একেবারেই হয় না । এইজন্য র্তাহারা প্রায়ই সম্ভোগপ্রিয়, ভোগাসক্ত হইয়া থাকেন। শুধু আহারে নয়, ইন্দ্ৰিয়াধীন সকল কার্যেই তাহারা কিছু লুব্ধ, কিছু মুগ্ধ, কিছু মোহাচ্ছন্ন । অসংযতেন্দ্ৰিয় এবং সংযমশিক্ষাহীন, সম্ভোগপ্রিয় এবং ভোগাসক্ত, মুগ্ধ এবং মোহাচ্ছন্ন, কথাগুলার প্ৰায় একই অর্থ। উপস্থিতক্ষেত্রে চন্দ্ৰনাথবাবুর বিশেষ বক্তব্য এই যে, নব্যদের লোভটা কিছু বেশি প্ৰবল । প্রাচীন ব্ৰাহ্মণবটুদের ঐ প্রবৃত্তিটা যে মোটেই ছিল না, এ কথা চন্দ্রনাথবাবু বলিলেও আমরা স্বীকার করিতে পারিব না। লেখকমহাশয় লুব্ধ পশুর সহিত নব্য পশুখাদকের কোনো প্ৰভেদ দেখিতে পান না। কিন্তু এ কথা জগদবিখ্যাত যে, ব্ৰাহ্মণপণ্ডিতকে বশ করিবার প্রধান উপায় আহার এবং দক্ষিণা । অধ্যাপকমহাশয় ঔদরিকতার দৃষ্টান্তস্থল। যিনি একদিন লুচিদধির গন্ধে উন্মনা হইয়া জাতিচু্যত ধনীগৃহে উর্ধ্বশ্বাসে ধাবমান হইয়াছিলেন এবং আহারান্তে বাহিরে আসিয়া কৃত কার্য অস্নানমুখে অস্বীকার করিয়াছিলেন তাহারই পৌত্র আজ ‘চপকট্রলেটের সৌরভে বাবুর্চি বাহাদুরের খাপরেলখচিত মুর্গিমণ্ডপাভিমুখে ছোটেন’ এবং অনেকে তাহা বাহিরে আসিয়া মিথ্যাচরণপূর্বক গোপনাও করেন না। উভয়ের মধ্যে কেবল সময়ের ব্যবধান। কিন্তু সংযম ও সাত্ত্বিকতার বড়ো ইতারবিশেষ দেখি না । তাহা ছাড়া নব্য ব্ৰাহ্মণদিগের প্রাচীন পিতৃপুরুষেরা যে ক্ৰোধবর্জিত ছিলেন র্তাহাদের তর্ক ও বিচারপ্রণালী দ্বারা তাহাও প্ৰমাণ হয় না । যাহা হউক, প্রাচীন বঙ্গসমাজে ষড়রিপু যে নিতান্ত নিজীবিভাবে ছিল এবং আধুনিক সমাজে আমিষের গন্ধ পাইবামাত্র তাহারা সব ক'টা উদাম হইয়া উঠিয়াছে, এটা অনেকটা লেখক মহাশয়ের কল্পনামাত্র। র্তাহার জানা উচিত, আমরা প্রাচীন কালের যুবকদিগকে প্রত্যক্ষ দেখিতে পাই না ; যাহাদিগকে দেখি তাহারা যৌবনলীলা বহুপূর্বে সমাধা করিয়া ভোগাসক্তির বিরুদ্ধে উপদেশ দিতে আরম্ভ করিয়াছেন । এইজন্য আমাদের সহজেই ধারণা হয়, তবে বুঝি সেকালে কেবলমাত্র হরিনাম এবং আত্মারই আমদানি ছিল । কিন্তু মাঝে মাঝে যে-সকল পীতবর্ণ জীৰ্ণ বৈষয়িক এবং রাসনিমগ্ন পরিপক্ক ভোগী বৃদ্ধ দেখা যায়, তাহাতে বুঝা যায়, সত্যযুগ আমাদের অব্যবহিত পূর্বেই ছিল না । সামিষ এবং নিরামিষ আহারের তুলনা করা আমার উদ্দেশ্য নহে। আমি কেবল এইটুকু বলিতে চাহি, আহার সম্বন্ধে প্ৰবন্ধ লিখিতে গিয়া একটা ঘরগড় দৈববাণী রচনা করা আজকালকার দিনে শোভা পায় না। এখনকার কালে যদি কোনো দৈবদুৰ্যোগে কোনো লোকের মনে সহসা একটা অভ্রান্ত সত্যের আবির্ভাব হইয়া পড়ে অথচ সঙ্গে সঙ্গে কোনো প্রমাণ দেখা না দেয়, তবে তাহার একমাত্র • কর্তব্য সেটাকে মনে মনে পরিপাক করা। গুরুর ভঙ্গিতে কথা বলার একটা নূতন উপদ্রব বঙ্গসাহিত্যে সম্প্রতি দেখা দিতেছে। এরূপ ভাবে সত্য কথা বলিলেও সত্যের অপমান করা হয়, কারণ সত্য কোনো লেখকের নামে বিকাইতে চাহে না, আপনার যুক্তি দ্বারা সে আপনাকে প্রমাণ করে, লেখক উপলক্ষ মাত্র । অবশ্য, রুচিভেদে অভিজ্ঞতাভেদে আমাদের কোনো জিনিস ভালো লাগে কোনো জিনিস মন্দ । লাগে, সকল সময়ে তাহার কারণ নির্দেশ করিতে পারি না। তাহার যেটুকু কারণ তাহা আমাদের সমস্ত জীবনের সহিত জড়িত, সেটাকে টানিয়া বাহির করা ভারি দুরূহ। মনের বিশেষ গতি অনুসারে অসম্পূর্ণ প্রমাণের উপরেও আমরা অনেক মত গঠিত করিয়া থাকি ; এইরূপ ভুরি ভুরি অপ্রমাণিত