পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট । সমাজ · १०७ মহাশয়ের মতো সুযোগ্য ভাবুক ব্যক্তি “সামাজিক ব্যাধি ও তাহার প্রতীকার” সম্বন্ধে যাহা আলোচনা করিবেন তাহা আমাদের ঔৎসুক্যজনক না হইয়া থাকিতে পারে না । তথাপি আমরা লেখকমহাশয়ের এবং তাহার প্রবন্ধের নামের দ্বারা স্বভাবত আকৃষ্ট হইয়াও অতিশয় অধিক প্রত্যাশা করি নাই। কারণ, আমরা নিশ্চয় জানি, সামাজিক ব্যাধির কোনো অভূতপূর্ব পেটেন্ট ঔষধ কবি বা কবিরাজের কল্পনার অতীত । আসল কথা, ঔষধ চিরপরিচিত, কিন্তু নিকটে তাহার | ডাক্তারখানা কোথায় পাওয়া যায়, সেইটো ঠাহর করা শক্ত । কারণ, মানসিক ব্যাধির ঔষধও মানসিক এবং ব্যাধি থাকাতেই সে-ঔষধ দুস্তপ্ৰাপ্য তবে এ সম্বন্ধে আলোচনার সময় আসিয়াছে ; কেননা আমাদের মধ্যে একটা দ্বিধা জন্মিয়াছে, তাহাতে সন্দেহ নাই। প্রাচীন ভারতবর্ষ এবং আধুনিক সভ্যজগতের চৌমাথার মোড়ে আমরা মাথায় হাত দিয়া বসিয়া আছি । কিছু পূর্বে এরূপ আন্তরিক দ্বিধা আমাদের শিক্ষিতসমাজে ছিল না। স্বদেশাভিমানীরা মুখে যিনি যাহাই বলিতেন, আধুনিক সভ্যতার উপর তীহাদের অটল বিশ্বাস ছিল। ফরাসীবিদ্রোহী, দাসত্ববারণচেষ্টা এবং উনবিংশ শতাব্দীর প্রত্যুষকালীন ইংরেজি কাব্যসাহিত্য বিলাতি সভ্যতাকে যে ভাবের ফেনায় ফেনিল করিয়া তুলিয়াছিল, তখনো তাহা মরে নাই- সে-সভ্যতা জাতিবর্ণনির্বিচারে সমস্ত মনুষ্যত্বকে বরণ করিতে প্ৰস্তুত আছে, এমনই একটা আশ্বাসবাণী ঘোষণা করিতেছিল। আমাদের তাহাতে তাক লাগিয়া গিয়াছিল। আমরা সেই সভ্যতার ঔদার্যের সহিত ভারতবষীয় সংকীর্ণতার তুলনা করিয়া যুরোপকে বাহবা দিতেছিলাম । 藤 বিশেষত আমাদের মতো অসহায় পতিতজাতির পক্ষে এই ঔদার্য অত্যন্ত রমণীয় । সেই অতিবদ্যান্য সভ্যতার আশ্রয়ে আমরা নানাবিধ সুলভ সুবিধা ও অনায়াসমহত্ত্বের স্বপ্ন দেখিতে লাগিলাম। মনে আশা হইতে লাগিল, কেবল স্বাধীনতার বুলি আওড়াইয়া আমরা বীরপুরুষ হইব, এবং কলেজ হইতে দলে দলে উপাধিগ্রহণ করিয়াই আমরা সাম্যসৌভ্রাত্ৰস্বতন্ত্র্যমন্ত্রদীক্ষিত পাশ্চাত্য সভ্যতার নিকট হইতে স্বাধীনশাসনের দাবি করিব । চৈতন্য যখন ভক্তিবন্যায় ব্ৰাহ্মণ চণ্ডালের ভেদবাধ ভাঙিয়া দিবার কথা বলিলেন তখন যো-হীনবর্ণ সম্প্রদায় উৎফুল্প হইয়া ছুটিল, তাহারা বৈষ্ণব হইল। কিন্তু ব্ৰাহ্মণ হইল না । আমরাও সভ্যতার প্রথম ডাক শুনিয়া যখন নাচিয়াছিলাম তখন মনে করিয়াছিলাম, এই পাশ্চাত্যমন্ত্র গ্রহণ করিলেই আর জেতা-বিজেতার ভেদ থাকিবে না- কেবল মন্ত্রবলে গৌরে-শ্যামে একাঙ্গ হইয়া যাইবে । এইজন্যই আমাদের এত বেশি উচ্ছাস হইয়াছিল এবং বায়রনের সুরে সুর বঁাধিয়া এমন উচ্চ সপ্তকে তান লাগাইয়াছিলাম। এমন পতিতপাবন সভ্যতাকে পতিতজাতি যদি মাথায় করিয়া না লইবে, তবে । কে লইবে । · কিন্তু আমরা বৈষ্ণব হইলাম, ব্ৰাহ্মণ হইলাম না। আমাদের যাহা-কিছু ছিল ছাড়িতে প্ৰস্তুত হইলাম, কিন্তু ভেদ সমানই রহিয়া গেল। এখন মনে মনে ধিককার জন্মিতেছে ; ভাবিতেছি, কিসের জন্যঘর কৈানু বাহির, বাহির কৈানুঘর, পরাকৈানু আপন, আপন কৈানু পর ! ! বঁশি বাজিয়াছিল মধুর, কিন্তু এখন মনে হইতেছে যে ঝাড়ের তরল বঁাশি তারি লাগি পাও, ডালে মুলে উপাড়িয়া সাগরে ভাসাও । এখন বিলাতি শিক্ষাটাকে ডালেমূলে উপড়াইবার ইচ্ছা হইতেছে। কিন্তু কথা এই যে কেবলমাত্র বঁশির আওয়াজে যিনি কুলত্যাগ করেন, তাহাকে অনুতাপ করিতেই হইবে। মহত্ত্ব ও মনুষ্যত্ব -লাভ এত সহজ মনে করাই ভুল। আমরা কথঞ্চিৎপরিমাণে ইংরেজের ভাষা শিখিয়াছি বলিয়াই যে ইংরেজ জেতা-বিজেতার সমস্ত প্ৰভেদ ভুলিয়া আমাদিগকে তাহার রাজতত্তায় তুলিয়া লইবে এ কথা স্বপ্নেও