পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট । শব্দতত্ত্ব ৭৪৩ তাহা হইলে উভয় প্রবন্ধের ওজনের প্রভূত প্রভেদ বুঝিতে র্তাহাদের ক্ষণমাত্র বিলম্ব হইবে না। কিন্তু নিশ্চয় জানি, অনেক পাঠকই শ্রমস্বীকারপূর্বক আমাদের এ পরামর্শ গ্ৰহণ করিবেন না, সুতরাং নানা কারণে সংকোচসত্ত্বেও উপসৰ্গঘটিত আলোচনা সম্বন্ধে আমাদের মত প্ৰকাশ করিতে বাধ্য হইলাম । শ্ৰীযুক্ত দ্বিজেন্দ্ৰনাথ ঠাকুর মহাশয় স্পষ্টই স্বীকার করিয়াছেন, উপসর্গের অর্থবিচার সম্বন্ধে তিনি একটি পথ নির্দেশ করিয়াছেন মাত্র। এবং সে-পথ তাহার নিজের আবিষ্কৃত কোনো গোপন পথ নহে, তাহা বিজ্ঞানসম্মত রাজপথ । তিনি দৃষ্টান্তপরম্পরা হইতে সিদ্ধান্তে নীত হইয়া উপসর্গগুলির অর্থ-উদ্ধারের চেষ্টা করিয়াছেন । সেই চেষ্টার ফল সর্বত্র না-ও যদি হয়, তথাপি সেই প্ৰণালী একমাত্র । সমীচীন প্ৰণালী । প্ৰাচীন শব্দশাস্ত্রে এইপ্ৰকার প্রণালী অবলম্বনে উপসর্গের অর্থনির্ণয় হইয়াছিল বলিয়া জানি না । শাস্ত্রী মহাশয় লিখিতেছেন, “আমাদের দেশীয় প্রাচীনতম শব্দাচাৰ্যদিগের মতে উপসর্গগুলি ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয় । একই উপসর্গের ধাতুভেদে প্রয়োগভেদে নানা অর্থ লক্ষিত হয় । ঐ-সকল প্রয়োগের অর্থ অনুগত (generalize) করিয়া তাহারা এক-একটি উপসর্গের কতকগুলি করিয়া অর্থ স্থির করিয়াছেন।” কথা এই যে, তাহারা যাহা স্থির করিয়াছেন তাহা প্রত্যক্ষ না থাকায় তাহাদের কথা আমরা মানিয়া লইতে পারি, পরখ করিয়া লইতে পারি না। এ সম্বন্ধে দুই-একটা দৃষ্টান্ত দিতে ইচ্ছা! করি। মেদিনীকোষকার অপ উপসর্গের নিম্নলিখিত অর্থ নির্দেশ করিয়াছেন- অপকৃষ্টাৰ্থঃ ; বর্জনার্থঃ, বিয়োগঃ, বিপর্যয়ঃ ; বিকৃতিঃ, চৌর্যাং, নির্দেশঃ, হর্ষঃ । আমাদের মনে প্ৰথমে এই সংশয় উপস্থিত হয় যে, যে-অর্থ ক্রিয়ার বিশেষণ ভাবে ব্যবহৃত হইতে না পারে, তাহা উপসৰ্গ সম্বন্ধে প্ৰযুজ্য কিরূপে হয় । অপ উপসর্গের চৌর্য অর্থ সহজেই সংগত বলিয়া বোধ হয় না । অবশ্য অপচয় বা অপহরণ শব্দে চৌর্য অর্থপ্রকাশ করে, অপ উপসর্গের অপকৃষ্টাৰ্থই তাহার কারণ। হরণ শব্দের অর্থ স্থানান্তরকরণ, চয়ন শব্দে গ্রহণ বুঝায় ; অপ উপসৰ্গযোগে তাহাতে দূষিত ভাবের সংস্রব হইয়া চৌর্য অর্থ নিম্পন্ন হয় । যুরোপীয় ভাষায় abduction শব্দের অর্থ অপহরণ- ducere ধাতুর অর্থ নয়ন, তাহার সহিত ab (অপ) উপসর্গ যুক্ত হইয়া নীচার্থে চৌর্য বুঝাইতেছে। অপ উপসর্গের হর্ষ অর্থ সম্বন্ধেও আমাদের ঐরূপ সন্দেহ আছে। কিন্তু প্ৰাচীন শব্দাচাৰ্য কোন পথ অবলম্বন করিয়া এই সকল অর্থে উপনীত হইয়াছেন, তাহা আমরা জানি না ; সুতরাং হয় তাহার কথা তর্কের অতীত বলিয়া মানিয়া লইতে হয়, নয়তো বিতর্কের মধ্যেই থাকিতে হয়। দুর্গাদাস সং উপসর্গের নানা অর্থের মধ্যে “ঔচিত্য অর্থ নিদর্শন করিয়াছেন। অবশ্য, সমুচিত শব্দের দ্বারা ঔচিত্য ব্যক্ত হয়, সে কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তু তাহাতে সং । উপসর্গের ঔচিত্য অর্থ সূচনা করে না। সংগতি, সমীচীনতা, সমীক্ষকারিতা, সামঞ্জস প্রভৃতি শব্দের অভ্যন্তরে ইঙ্গিতে যে ঔচিত্যের ভাব আছে, সং উপসৰ্গই তাহার মুখ্য ও মূল কারণ নহে। এরূপ বিচার করিতে গেলে উপসর্গের অর্থের অন্ত পাওয়া যায় না ; তাহা হইলে বলা যাইতে পারে সং উপসর্গের অর্থ সম্মান এবং প্রমাণস্বরূপ সম্মান, সমাদর, সম্রম, সমভ্যর্থন প্রভৃতি উদাহরণ উপস্থিত করা যাইতে পারে। দুর্গাদাস সং উপসর্গের অর্থ সম্বন্ধে বলিয়াছেন সম প্রকর্ষীশ্লেষনৈরন্তযোঁচিত্যাভি মুখ্যেষু ; এই আভিমুখ্য অর্থ স্পষ্টতই সং উপসর্গের বিশেষ অর্থ নহে- কারণ, সং উপসর্গের যে আশ্লেষ অর্থ দেওয়া হইয়াছে আভিমুখ্য তাহার একটি অংশ, বৈমুখ্যও তাহার মধ্যে আসিতে পারে। সমাবেশ, সমাগম, সংকুলতা বলিলে যে আশ্লেষ বা একত্র হওন বুঝায় তাহার মধ্যে— আভিমুখ্য, বৈমুখ্য, । উন্মুখতা, অধোমুখতা, সমস্তই থাকিতে পারে ; এ স্থলে বিশেষভাবে আভিমুখ্যের উল্লেখ করাতে অন্যগুলিকে নিরাকৃত করা হইয়াছে। যে-জনতায় নানা লোক নানা দিকে মুখ করিয়া আছে, এমন-কি, কেহ কাহারও অভিমুখে নাই তাহাকেও জনসমাগম বলা যায় ; কারণ, সং উপসর্গের মূল অর্থ আশ্লেষ, তাহার মধ্যে আভিমুখ্য থাকিলেও চলে না-থাকিলেও চলে। ইহাও দেখা যাইতেছে, উপসর্গ সম্বন্ধে প্রাচীন শব্দাচাৰ্যদিগের অর্থতালিকায় পরস্পরের মধ্যে অনেক কমবেশি আছে। মেদিনীকোষকার সং উপসর্গের যে “শোভনাৰ্থ উল্লেখ করিয়াছেন দুর্গাদাসের টীকায় তাহা নাই ; দুর্গাদাসের ঔচিত্য আভিমুখ্য অর্থ মেদিনীকোষে দেখা যায় না। এই সকল শব্দাচার্যের অগাধ পণ্ডিত্য ও কুশাগ্ৰবুদ্ধিতা