পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ԳԵ8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী উদ্দেশ্যকে অভিভূত করিয়া নিজেই চরম পদ অধিকার করিতে চায়, তখন তাহার মতো মননের বাধা আর কী হইতে পারে। কতকগুলি বিশেষ শব্দসমষ্টির মধ্যে কোনো অলৌকিক শক্তি আছে এই বিশ্বাস যখন মানুষের মনকে পাইয়া বসে তখন সে আর সেই শব্দের উপরে উঠিতে চায় না । তখন মনন ঘুচিয়া গিয়া সে উচ্চারণের ফাদেই জড়াইয়া পড়ে। তখন চিত্তকে যাহা মুক্ত করিবে: বলিয়াই রচিত তাহাই চিত্তকে বদ্ধ করে । এবং ক্রমে দাড়ায় এই, মন্ত্ৰ পড়িয়া দীর্ঘ জীবন লাভ করা, মন্ত্র পড়িয়া শত্রু জয় করা ইত্যাদি নানাপ্রকার নিরর্থক দুশ্চেষ্টায় মানুষের মূঢ় মন প্রলুব্ধ হইয়া ঘুরিতে থাকে। এইরূপে মন্ত্রই যখন মননের স্থান অধিকার করিয়া বসে তখন মানুষের পক্ষে তাহা অপেক্ষা শুষ্ক জিনিস আর কী হইতে পারে । যেখানে মন্ত্রের এরূপ ভ্ৰষ্টতা সেখানে মানুষের দুৰ্গতি আছেই। সেই সমস্ত কৃত্রিম বন্ধন-জাল হইতে মানুষ আপনাকে উদ্ধার করিয়া ভক্তির সজীবতা ও সরসতা -লাভের জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠে, ইতিহাসে বারংবার ইহার প্রমাণ দেখা গিয়াছে। যাগযজ্ঞ মন্ত্রতন্ত্র যখনই অত্যন্ত প্রবল হইয়া মানুষের মনকে চারি দিকে বেষ্টন করিয়া ধরে তখনই তো মানবের গুরু মানবের হৃদয়ের দাবি মিটাইবার জন্য দেখা দেন ; তিনি বলেন, পাথরের টুকরা দিয়া রুটির টুকরার কাজ চালানো যায় না, বাহ্য অনুষ্ঠানকে দিয়া অন্তরের শূন্যতা পূৰ্ণ করা চলে না । কিন্তু তাই বলিয়া এ কথা কেহই বলে না যে, মন্ত্র যেখানে মননের সহায়, বাহিরের অনুষ্ঠান যেখানে অন্তরের ভাবস্ফুর্তির অনুগত, সেখানে তাহা নিন্দনীয়। ভাব তো। রূপকে কামনা করে, কিন্তু রূপ। যদি ভাবকে মারিয়া একলা রাজত্ব করিতে চায়। তবে বিধাতার দণ্ডবিধি -অনুসারে তাহার কপালে মৃত্যু আছেই। কেননা, সে যত দিনই বঁাচিবে তত দিনই কেবলই মানুষের মনকে মারিতে থাকিবে । ভাবের পক্ষে রূপের প্রয়োজন আছে বলিয়াই রূপের মধ্যে লেশমাত্র অসতীত্ব এমন নিদারুণ । যেখানেই সে নিজেকে প্ৰবল করিতে চাহিবে সেইখানেই সে নির্লজ, সে অকল্যাণের আকর । কেননা, ভাব যে রূপকে টানিয়া আনে। সে যে প্রেমের টান, আনন্দের টান- রূপ যখন সেই ভাবকে চাপা দেয়। তখন সে সেই প্ৰেমকে আঘাত করে, আনন্দকে আচ্ছন্ন করে- সেইজন্য যাহারা ভাবের ভক্ত তাহারা রূপের এইরূপ ভ্ৰষ্টাচার একেবারে সহিতে পারে না । কিন্তু রূপে তাহাদের পরমানন্দ, যখন ভাবের সঙ্গে তাহার পূর্ণ মিলন দেখে । কিন্তু শুধু রূপের দাসখত মানুষের সকলের অধম দুৰ্গতি । র্যাহারা মহাপুরুষ তাহারা মানুষকে এই দুৰ্গতি হইতেই উদ্ধার করিতে আসেন । তাই অচলায়তনে এই আশার কথাই বলা হইয়াছে যে, যিনি গুরু। তিনি সমস্ত আশ্রয় ভাঙিয়া চুরিয়া দিয়া একটা শূন্যতা বিস্তার করিবার জন্য আসিতেছেন না ; তিনি স্বভাবকে জাগাইবেন, অভাবকে ঘুচাইবেন, বিরুদ্ধকে মিলাইবেন ; যেখানে অভ্যাসমাত্র আছে সেখানে লক্ষ্যকে উপস্থিত করিবেন, এবং যেখানে তপ্ত বালু-বিছানো খাদ পড়িয়া আছে মাত্র সেখানে প্ৰাণপরিপূর্ণ রসের ধারাকে বহাইয়া দিবেন। এ কথা কেবল যে আমাদেরই দেশের সম্বন্ধে খাটে তাহা নহে ; ইহা সকল দেশেই সকল মানুষেরই খাটে । অবশ্য এই সর্বজনীন সত্য অচলায়তনে ভারতবষীর রূপ ধারণ করিয়াছে ; তাহা যদি করিত তবে উহা অপাঠ্য হইত। ‘মনে করিয়াছিলাম সংক্ষেপে বলিব । কিন্তু “নিজের কথা পাচ কাহিনী হইয়া পড়ে ; বিশেষত শ্রোতা যদি সহৃদয় ও ক্ষমাপরায়ণ হন । ইতিপূর্বেও আপনার প্রতি জুলুম করিয়া সাহস বাড়িয়া গেছে ; এবারেও প্রশ্রয় পাইব এ ভরসা। মনে আছে । ইতি ৩রা অগ্রহায়ণ ১৩:১৮, শান্তিনিকেতন’ আৰ্য্যাবৰ্ত্তের যে সংখ্যাতে (অগ্রহায়ণ ১৩১৮) রবীন্দ্রনাথের এই প্ৰত্যুত্তর মুদ্রিত হয় সেই সংখ্যাতেই অক্ষয়চন্দ্র সরকার, ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ফোয়ারা” গ্রন্থের সমালোচনা-প্রসঙ্গে, পূর্বসংখ্যা আৰ্য্যাবৰ্ত্তে প্ৰকাশিত র্তাহার অচলায়তন আলোচনার ও রবীন্দ্রনাথের বিরূপ সমালোচনা করেন। অক্ষয়চন্দ্রের আলোচনা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ ললিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়কে পত্রোত্তরে লেখেন