পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় ध्z०१ তাহা বঙ্গভাষায় হইতে পারে ও হইলে অধিক শোভা পায় ; এবং সেই সকল স্থলেই স্বদেশীয় ভাষায় মনের ভাব ব্যক্ত করার পদ্ধতি চলিলেও অনেকটা উপকার হইতে পারে । আনন্দমোহনবাবু লিখিয়াছেন : পৌষ মাসের সাধনায় প্রকাশিত “শিক্ষার হেরফের’ নামক প্ৰবন্ধটি অত্যন্ত আহলাদের সহিত পড়িয়াছি। আপনি এ সম্বন্ধে যাহা লিখিয়াছেন, অনেক পূর্ব হইতে আমারও সেই মত ; সুতরাং সেই মত এমন অতি সুন্দরভাবে এবং দক্ষতার সহিত সমর্থিত ও প্রচারিত হইতে দেখিয়া আনন্দিত হইব ইহাও স্বাভাবিকই। প্ৰবন্ধটি যেমন গুরুতর বিষয়সম্বন্ধীয়, ভাবগুণে এবং ভাষালালিত্যে আবার তেমনি মধুর ও উপাদেয় হইয়াছে । এখন আলোচ্য, প্ৰদৰ্শিত অনিষ্টের প্রতিকারের উপায় কী । বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষার ভাষা এবং নিয়মাদি সম্বন্ধে কতক কতক পরিবর্তন করিলে উপকার হইতে পারে। কিন্তু এই বিষয়ের আমি যখনই অবতারণা করিয়াছি তখনই আমাদের স্বদেশীয়দের নিকট হইতেই আপত্তি উত্থাপিত হইয়াছে। এতৎ সম্বন্ধে আমাদের মধ্যে পাবলিক ও পিনিয়ান অনেকটা পরিবর্তন হওয়া আবশ্যক । আমি সময়ে সময়ে এ সম্বন্ধে প্ৰস্তাব বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মুখে আনিব মনে করিয়াছি, কিন্তু যে-পর্যন্ত এই পরিবর্তন সাধিত না হয় কিছুই করা যাইতে পরিবে না বলিয়া নিরস্ত হইয়াছি। আশা করি, এই পরিবর্তনসংসাধন পক্ষে আপনার সুন্দর প্ৰবন্ধটি বিশেষ সাহায্য করিবে এবং এই উদ্দেশ্যে এই প্রবন্ধের বহুল রূপে প্রচার প্রার্থনীয়। উক্ত তিন পত্র হইতে এইরূপ অনুমান হয় যে, সিন্ডিকেটের সভ্যগণ বাঙালির শিক্ষায় বাংলার কোনো উপযোগিতা স্বীকার করেন না, এবং আমাদের স্বদেশীয়দের নিকট হইতেই প্ৰধানত আপত্তি উত্থাপিত হইয়াছে । অবশ্য, আমাদের স্বদেশীয়েরা যে এ সম্বন্ধে আপত্তি করিবেন তাহাতে আশ্চর্য কিছুই নাই । যদি না করিতেন। তবে আমাদের দেশের এমন দুর্দশা হইবে কেন । কিন্তু কিছু আশ্চৰ্যও আছে। আমরা কখনো কিছুতে আপত্তি করি নাই বলিয়াই আমাদের এত দুৰ্গতি ; দেশের উপর যখন যে-কোনো অমঙ্গলস্রোত আসিয়া পড়িয়াছে আমরা বিনা। আপত্তিতে তাহার নিকট মস্তক নত করিয়া দিয়াছি ; স্বদেশের কথা, ভবিষ্যতের কথা এক মুহুর্তের জন্য ভাবিও নাই। আজ আমরা ইংরেজের কল্যাণে যদি-বা আপত্তি করিতে শিখিলাম, অভাগার অদৃষ্ট এমনই, অনেক সময় দেশের মঙ্গল প্ৰস্তাবে আপত্তি করিয়া বসি । বোধ হয়, আপত্তি করিতেই একটা সুখ আছে। নতুবা, স্বদেশী ভাষার সাহায্য ব্যতীত কখনোই স্বদেশের স্থায়ী কল্যাণ সাধিত হইতে পারে না, এ কথা কে না বোঝে । । কিন্তু দুৰ্দৈবক্রমে সহজ কথা না বুঝিলে তাহার মতো কঠিন কথা আর নাই। কারণ, কঠিন কথা না বুঝিলে সহজ কথার সাহায্যে বুঝাইতে হয়, কিন্তু সহজ কথা না বুঝিলে আর উপায় দেখা যায় না । দেশের অধিকাংশ লোকের শিক্ষার উপর যদি দেশের উন্নতি নির্ভর করে, এবং সেই শিক্ষার গভীরতা ও স্থায়িত্বের উপর যদি উন্নতির স্থায়িত্ব নির্ভর করে, তবে মাতৃভাষা ছাড়া যে আর কোনো গতি নাই, এ কথা কেহ না বুঝিলে হাল ছাড়িয়া দিতে হয়। রাজা কত আসিতেছে। কত যাইতেছে ; পাঠান গেল, মোগল গেল, ইংরেজ আসিল, আবার কালক্রমে ইংরেজও যাইবে- কিন্তু ভাষা সেই বাংলাই চলিয়া আসিতেছে এবং বাংলাই চলিবে ; যাহা-কিছু বাংলায় থাকিবে তাঁহাই যথার্থ থাকিবে এবং চিরকাল থাকিবে । ইংরেজ যদি কাল চলিয়া যায়। তবে পরশ্ব ঐ বড়ো বড়ো বিদ্যালয়গুলি বড়ো বড়ো সৌধ বুদবুদের মতো প্রতীয়মান হইবে । ভালোরূপ নজর করিয়া দেখিলে আজও ওগুলাকে বুদবুদ বলিয়া বুঝা যায় । উহারা আমাদের বৃহৎ লোকপ্রবাহের মধ্যে অত্যন্ত লঘুভাবে অতিশয় অল্প স্থান অধিকার করিয়া আছে ।