পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ষষ্ঠ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় br> > কথঞ্চিৎ বোধগম্য হয় । কিন্তু ভাষা এবং ব্যাকরণ দুই যখন বিদেশী তখন কাহার সাহায্যে। কাহাকে বুঝিবে । তখন সূত্রও অপরিচিত, উদাহরণও অপরিচিত । যে ভাষা সর্বাপেক্ষা পরিচিত সেই ভাষার সাহায্যে ব্যাকরণজ্ঞান লাভ করাই প্রশস্ত নিয়ম ; অবশেষে একবার ব্যাকরণজ্ঞান । জন্মিলে সেই ব্যাকরণের সাহায্যে অপরিচিত ভাষাশিক্ষা সহজ হইয়া আসে। অতএব, শিখিবার প্রণালীটি যদি একবার মাতৃভাষার সাহায্যে অপেক্ষাকৃত সহজে আয়ত্ত হইয়া আসে, মনটি যদি শিক্ষার জন্য প্ৰস্তুত হইয়া উঠে, তবে ধারণাশক্তি যে কতটা পরিপক হইয়া উঠে, কত অনাবশ্যক পীড়ন, কঠিন চেষ্টা ও শরীরমনের অবসাদ হইতে নিস্কৃতি পাওয়া যায়, কত অল্প সময়ে ও কত স্থায়ীরূপে নূতন শিক্ষা গ্ৰহণ করা যায়, তাহা যাহারা দৃষ্টান্ত দেখিয়াছেন তাহারাই জানেন । বাল্যকাল হইতেই ইংরেজিভাষা শিক্ষা দেওয়া হউক। কিন্তু বাংলার আনুষঙ্গিক রূপে অতি অল্পে অল্পে, তাহা হইলে বাংলাশিক্ষা ইংরেজিশিক্ষার সাহায্য করিবে । ইতিহাস ভুগোল অঙ্ক প্রভৃতি শিক্ষার বিষয়গুলি বাংলায় শিখাইয়া ইংরেজিকে কেবল ভাষাশিক্ষা রূপে শিখাইলে ভাষারূপে ইংরেজি শিখিবার সময় অধিক পাওয়া যায় ; বুঝিয়া পড়বার এবং অভ্যাস করিয়া লিখিবার যথার্থ অবসর থাকে । সকলেই জানেন, আজকাল আমাদের ছাত্রেরা যো-পরিমাণে অনেক বিষয় শেখে সেই পরিমাণে ইংরেজি অল্প শেখে । তাহার প্রধান কারণ, আগাগোড়া মুখস্থ করিতে গিয়া ইংরেজি বুঝিবার এবং রচনা করিবার সময় পায় না । শিক্ষণীয় বিষয়গুলি যদি বাংলায় পাইতাম তবে ইংরেজিভাষাশিক্ষা যে কত সহজসাধ্য হইত। তাহা বলা যায় না । তাহা হইলে শিক্ষার বিষয়গুলি এখনকার অপেক্ষা গভীরতর এবং ইংরেজিভাষাজ্ঞানের পরীক্ষা এখনকার অপেক্ষা অনায়াসে দুরূহতার করা যাইতে পারিত । বঙ্কিমবাবুর ক্ষীণস্বর র্যাহাদের শ্রুতিগম্য হয় নাই, আমার এ ক্ষুদ্র প্রবন্ধ তঁহাদের দৃষ্টিগোচর হইবে না, হইলেও কোনো ফলের প্রত্যাশা করি না । কিন্তু যে-পাঠকগণ, অনুগ্রহ অথবা অনুরাগ -বশত আমাদের বাংলা কাগজ পড়িয়া থাকেন তাহদের প্রতি কিঞ্চিৎ ভরসা রাখি । তাহারা যদি দেশের মঙ্গলের জন্য কথাটা ভালো করিয়া বিবেচনা করিয়া দেখেন, এবং ঘরে ঘরে আপনি আপন সন্তানকে মাতৃস্তন্যের ন্যায় মাতৃভাষার দ্বারা সম্যকরূপে পরিপুষ্ট ও পরিণত করিয়া তুলিতে চেষ্টা করেন তবে কালক্রমে দেশের যে শ্ৰী ও উন্নতি হইবে সভাসমিতিতে সহস্ৰ বৎসর ইংরেজি বক্তৃতা করিয়াও সেরূপ হইবে না। কেবল ভয় হয় এইজন্য যে, বাঙালি স্থায়ী গীেরব অপেক্ষা ক্ষণিক অহংকার-তৃপ্তি অধিক ভালোবাসে, ভবিষ্যৎ কার্যসিদ্ধির অপেক্ষা উপস্থিত করতালির জন্য অধিক লালায়িত ; এবং দেশের বৃহৎ কল্যাণ অপেক্ষা আশু ক্ষুদ্র স্বার্থের প্রলোভন গুরুতর ; তাহা ছাড়া মুখে। যেমনই গর্ব করি, আত্মশক্তি আত্মভাষা এবং কোনো আপনার জিনিসের প্রতিই আমাদের আন্তরিক বিশ্বাস নাই ; মনে স্থির করিয়া বসিয়া আছি যে, ইংরেজ গবর্মেন্ট আমাদের সমস্ত উন্নতিসাধন করিয়া দিবে, আমরা কেবল দরখাস্ত করিব, ইংরেজিভাষাতেই আমাদের সমস্ত জাতীয়শিক্ষা সাধন করিবে, আমরা কেবল অভিধান ধরিয়া মুখস্থ করিয়া গেলেই হইবে । “শিক্ষার আন্দোলনের ভূমিকা’ নামক যে-প্ৰবন্ধটি পরিশিষ্ট্রে মুদ্রিত হইয়াছে তাহা বঙ্গবিভাগ আন্দোলনের আনুষঙ্গিক শিক্ষাসমস্যা-সম্পর্কিত। ১৯০৫ সালের অক্টোবর মাসে বঙ্গবিভাগ আন্দোলনে ছাত্ৰগণের যোগদান নিষিদ্ধ করিয়া স্কুল-কলেজে সার্কুলার (কার্লাইল সাকুলার) প্রেরিত হইয়াছে, স্টেটসম্যান পত্রে (২২ অক্টোবর ১৯০৫, ৫ কার্তিক ১৩১২) এই সংবাদ প্রকাশিত হইলে বিদ্যালয় বর্জন ও জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য বাংলাদেশে যে-আন্দোলন। আরম্ভ হয়, তাহার বিস্তারিত বিবরণ (২৫ অগ্রহায়ণ ১৩১২ পর্যন্ত)-সহ ‘শিক্ষার আন্দোলন বা