পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্য · |SSRNව কবিকঙ্কণের কমলে-কামিনীতে একটি রূপসী ষোড়শী হস্তি গ্রাস ও উদগার করিতেছে, ইহাতে এমন পরিমাণ-সামঞ্জস্যের অভাব হইয়াছে, যে, আমাদের সৌন্দর্যজ্ঞানে অত্যন্ত আঘাত দেয়।* শিক্ষিত, সংযত, মার্জিত কল্পনায় একটি রূপসী যুবতীর সহিত গজাহার ও উদগীরণ কোনো মতেই একত্রে উদয় হইতে পারে না। ইহাতে কেহ না মনে করেন, আমি কবিকঙ্কণকে কবি বলি না। যে বিষয়ে তাহার শিক্ষার অভাব ছিল, সেই বিষয়ে তাহার পদস্থলন হইয়াছে; শু মন্ত্র পরিমাণ সামঞ্জস্য, যাহা সৌন্দর্যের সার, সে বিষয়ে তাহার শিক্ষার অসম্পূর্ণতা দেখি কল্পনারও শিক্ষা আবশ্যক করে। যাহাদের কল্পনা শিক্ষিত নহে, তাহারা অতিশয় অসম্ভব, অলৌকিক কল্পনা করিতে ভালোবাসে; বক্র দর্পণে মুখ দেখিলে নাসিক পরিমাণাধিক বৃহৎ এবং কপাল ও চিবুক নিতান্ত হ্রস্ব দেখায়। তাঁহাদের কুগঠিত কল্পনা-দর্পণে স্বাভাবিক দ্রব্য যাহা-কিছু পড়ে তাহার পরিমাণ ঠিক থাকে না; তাহার নাসা বৃহৎ ও তাহার কপাল খর্ব হইয়া পড়ে। তাহারা অসংগত পদার্থের জোড়াতাড়া দিয়া এক-একটা বিকৃতাকার পদার্থ গড়িয়া তোলে। তাহারা শরীরী পদার্থের মধ্যে অশরীরী ভাব দেখিতে পায় না। তথাপি যদি বল বালকের কবি, অর্থাৎ বালকদের হৃদয়ে বয়স্কদের অপেক্ষা কবিতা আছে, তবে নিতান্ত বালকের মতো কথা বলা হয়। প্রাচীন কালে অনেক ভালো কবিতা রচিত হইয়া গিয়াছে বলিয়াই বোধ হয়, এই মতের সৃষ্টি হইয়া থাকিবে যে, অশিক্ষিত ব্যক্তিরা বিশেষ রূপে কবি। তুমি বলে দেখি, ওটাহিটি দ্বীপবাসী বা এস্কুইমোদের ভাষায় কয়টা পাঠ্য কবিতা আছে? এমন কোন জাতির মধ্যে ভালো কবিতা আছে, যে জাতি সভ্য হয় নাই? যখন রামায়ণ মহাভারত রচিত হইয়াছিল, তখন প্ৰাচীনকাল বটে, কিন্তু অশিক্ষিত কাল কি ? রামায়ণ মহাভারত পাঠ করিয়া কাহারও মনে কি সে সন্দেহ উপস্থিত হইতে পারে? উনবিংশ শতাব্দীতে যে মহা মহা কবিরা ইংলন্ডে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, তঁহাদের কবিতায় কি উনবিংশ শতাব্দীর প্রভাব লক্ষিত হয় না ? Copleston কহেন "Never has there been a city of which its people might be more justly proud, whether they looked to its past or to its future than Athens in the days of AEschylus." অনেকে যে কল্পনা করেন যে, অশিক্ষিত অবস্থায় কবিত্বের বিশেষ স্মৃৰ্তি হয়, তাহার একটি কারণ এই বোধ হয় যে, তাহারা মনে করেন যে, একটি বস্তুর যথার্থ স্বরূপ না জানিলে তাহাতে “ কল্পনার বিচরণের সহস্ৰ পথ থাকে। সত্য একটি মাত্র, মিথ্যা অগণ্য। অতএব মিথ্যায় কল্পনার যেরূপ উদর পূর্তি হয়, সত্যে সেরূপ হয় না। পৃথিবীতে অখাদ্য যত আছে, তাহা অপেক্ষা খাদ্য বস্তু অত্যস্ত পরিমিত। একটি খাদ্য যদি থাকে তো সহস্ৰ অখাদ্য আছে। অতএব এমন মত কি

  • অনেকে তর্ক করেন যে, গণেশকে দুর্গ এক-একবার করিয়া চুম্বন করিতেছিলেন, তাহাই দূর হইতে দেখিয়া ধনপতি গজাহার ও উদগীরণ কল্পনা করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহা যথার্থনহে। কারণ কবিকঙ্কণচণ্ডীতেই আছে, যে, চৌষট্টি যোগিনী পদ্মের দলরূপ ধারণ করিল, ও জয়া হস্তিনী রূপে রূপান্তরিত হইল। অতএব গণেশের সহিত ইহার কোনো সম্পর্কই নাই। কেহ বা তর্ক করেন যে, যখন কবির উদ্দেশ্য বিস্ময় ভাবের উদ্দীপন করা, তখন, বর্ণনা যাহাতে অদ্ভুত হয়, তাহারই প্রতি কবির লক্ষ্য। কিন্তু এ কথার কোনো অর্থ নাই। সুকল্পনার সহিত বিস্ময় রসের কোনো মনান্তর নাই।

যখন অগাধ সমুদ্রের মধ্যে মর্যালশোভিত কুমুদ কহলার পদ্মবনের মধ্যে এক রূপসী ষোড়শী প্রতিষ্ঠিত করিলেন; সমস্তই সুন্দর; নীল জল, সুকুমার পদ্ম, পুষ্পের সুগন্ধ, ভ্রমরের গুঞ্জন, ইত্যাদি ইত্যাদি তখন মধ্য হইতে এক গজাহার আনিয়া আমাদের কল্পনায় আমন একটা নিদারুণ আঘাত দিবার তাৎপর্য কী? সুন্দর পদার্থ যেমন কবিত্বপূর্ণ বিস্ময় উৎপন্ন করিতে পারে, এমন-কি, আর কিছুতে পারে? অপাের সমুদ্রের মধ্যে পদ্মাসীনা ষোড়শী রমণীই কি যথেষ্ট বিস্ময়ের কারণ নহে? তাহার মস্তকের চারি দিকে ইন্দ্ৰধনুর মণ্ডল স্থাপন করো, তাহার করে তারকার বলয়, গলে তারকার হার বসাইয়া দেও দেখিয়া কে না আশ্চর্য হইবে ? :