পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ধর্ম/দৰ্শন M VOSV) সামাজিক সংস্কার, বহু পুরাতন হইতে পারে, কিন্তু সত্য তদপেক্ষা পুরাতন— সেই চিরপুরাতন সত্যের সহিত এই নবীন বাঙালি বালকের কোথায় পরিচয় হইয়াছিল? সেই সত্যের অভাবে গৃহবাস, সমাজের আশ্রয়, লৌকিক সুখশান্তি, এই গৃহপালিত তরুণ বাঙালির নিকটে কেমন করিয়া এত তুচ্ছ বোধ হইল ? সেই ভূমা সত্যসুখের আস্বাদ সে কবে কোথায় লাভ করিয়াছিল ? বঙ্গমাতা এই বালককে তাহার অন্যান্য শিশুর ন্যায় জ্ঞান করিয়া আপনার চিরপ্রচলিত ক্রীড়নকগুলি তাহার সম্মুখে একে একে আনিয়া উপস্থিত করিতে লাগিল; বালক কাতর কণ্ঠে বলিতে লাগিল, ইহা নহে, ইহা নহে- আমি ধর্ম চাহি, ধর্মের পুত্তলি চাহি না; আমি সত্য চাহি সত্যের প্রতিমা চাহি না।” বঙ্গমাতা কিছুতেই এই বালকটিকে ভুলইয়া রাখিতে পারিল না- সমস্ত পরিত্যাগ করিয়া সত্যের সন্ধানে সে একাকী বিশ্বজগতে বাহির হইয়া গেল। সে কোন এক সময় কেমন করিয়া বাংলাদেশের সমস্ত দেশাচার-লোকাচারের উপরে মস্তক তুলিয়া দেখিতে পাইয়াছিল যে, এই আচার-অনুষ্ঠানই চরম নহে, ইহার বাহিরে অসীম সত্য অনন্তকাল অমৃতপিপাসু ভক্ত মহাত্মাদের জন্য প্রতীক্ষা করিয়া বসিয়া আছে। পূর্বেই বলিয়াছি মহাপুরুষদের পদতলে ধরণী দেয়, তখন তাহারা বরঞ্চ নিজের অঙ্গপ্ৰত্যঙ্গের অস্তিত্ব অবিশ্বাস করিতে পারেন। কিন্তু সে বিশ্ববেষ্টনকারী দৃশ্যাতীত অনন্ত সত্যলোকের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দিহান হইতে পারেন না। নারিকেলের বহিরাবরণের ন্যায় সকল ধর্মেরই বাহ্যিক অংশ তাহার অন্তরস্থিত অমৃত্যরসকে নৃত্যুনাধিক পরিমাণে গোপন ও দুর্লভ করিয়া রাখে। তৃষার্তা রামমোহন রায় সেই সকল কঠিন আবরণ স্বহস্তে ভেদ করিয়া ধর্মের রসশস্য আহরণ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তিনি নিজে সংস্কৃত শিখিয়া বেদ-পুরাণের গহন অরণ্যের মধ্যে আপনার পথ কাটিয়া লইলেন, হিব্রু ও গ্ৰীক ভাষা শিখিয়া খৃস্টধর্মের মূল আকারের মধ্যে অবতরণ করিলেন, আরব্য ভাষা শিখিয়া কোরানের মূল মন্ত্রগুলি স্বকৰ্ণে শ্রবণ করিয়া লইলেন। ইহাই সত্যের জন্য তপস্যা। সত্যের প্রতি যাহার প্রকৃত বিশ্বাস নাই সে বিনা চেষ্টায় যাহা হাতের কাছে প্ৰস্তুত দেখিতে পায় তাহাকেই আশ্রয় করিয়া অবহেলে জীবনযাপন করিতে চাহে- কর্তব্যবিমুখ অলস ধাত্রীর ন্যায় মোহ পায় এবং জড়ত্বসাধনার দ্বারা আত্মাকে অভিভূত করিয়া সংসারাশ্রমে পরিপুষ্ট সুচিকুণ হইয়া ë (2) | একদিন বহু সহস্ৰ বৎসর পূর্বে সরস্বতীকুলে কোন-এক নিস্তব্ধ তপোবনে কোন-এক বৈদিক মহর্ষি ধ্যানাসনে বসিয়া উদাত্ত স্বরে গান গাহিয়া উঠিয়াছিলেন-- শৃশ্বস্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্র আ যে ধামানি দিব্যানি তছুঃ। বেদাহমেতং পুরুষং মহাস্তং আদিত্যবৰ্ণং তমসঃ পরস্তাৎ ॥ হে দিবধামবাসী অমৃতের পত্র-সকল, তোমরা শ্রবণ করো— আমি সেই তিমিরাতীত মহান পুরুষকে জানিয়াছি। রামমোহন রায়ও একদিন উষাকালে নির্বাণদীপ তিমিরাচ্ছন্ন বঙ্গসমাজের গাঢ়নিদ্ৰামগ্ন নিশ্চেন্তন লোকালয়ের মধ্যস্থলে দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিয়াছিলেন- হে মোহশয্যাশায়ী পুরবাসীগণ, আমি সত্যের দর্শন পাইয়াছি- তোমরা জাগ্রত হও! লোকাচারের পুরাতন শুষ্ক পৰ্ণশয্যায় সুখসুপ্ত প্রাণীগণ রক্তনেত্র উন্মীলন করিয়া সেই জাগ্রত মহাপুরুষকে রোষদৃষ্টিদ্বারা তিরস্কার করিতে লাগিল। কিন্তু সত্য যাহাকে একবার আশ্রয় করে সে কি আর সত্যকে গোপন করিতে পারে? দীপাবর্তিকায় অগ্নি যখন ধরিয়া উঠে তখন সেই শিখা লুক্কায়িত করা প্ৰদীপের সাধ্যায়ত্ত নহে- আমরা রুষ্ট হই আর সন্তুষ্ট হই, সে উধ্বমুখী হইয়া জুলিতে থাকিবে, তাহার অন্য গতি নাই। রামমোহন রায়েরও অন্য গতি ছিল না- সত্যশিখা তাহার অন্তরাত্মায় প্ৰদীপ্ত হইয়া