পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

se 89. লেখকের নিজের সম্বন্ধে আর-একটি কথা আছে। বঙ্কিমবাবু বলিয়াছেন ভারতীতে প্ৰকাশিত মল্লিখিত প্ৰবন্ধে গালিগালাজের বড়ো ছড়াছড়ি বড়ো বাড়াবাড়ি আছে। শুনিয়া আমি নিতান্ত বিস্মিত হইলাম। বঙ্কিমবাবুর লেখার প্রসঙ্গে আমার যাহা বলিবার বলিয়াছি কিন্তু বঙ্কিমবাবুকে কোথাও গালি দিই নাই। তাহাকে গালি দিবার কথা আমার মনেও আসিতে পারে না। তিনি আমার গুরুজন তুল্য, তিনি আমা অপেক্ষা কিসে না বড়ো! আমি তঁহাকে ভক্তি করি, আর কেই বা না করে। র্তাহার প্রথম সন্তান দুৰ্গেশনন্দিনী বোধ করি আমা অপেক্ষা বয়োজ্যেষ্ঠা। আমার যে এতদূর আত্মবিস্মৃতি ঘটিয়াছিল যে তাঁহাকে অমান্য করিয়াছি কেবলমাত্র অমান্য নহে ভঁাহাকে গালি দিয়াছি তাহা সম্ভব নহে। ক্ষুদ্ধ-হৃদয়ে অনেক কথা বলিয়াছি, কিন্তু গালিগালাজ হইতে অনেক দূরে আছি। মেছোেহাটার তো কথাই নাই আঁষটে গন্ধাটুকু পর্যন্ত নাই। যে স্থান উদধূত করিয়াছেন তাহা গালি নহে। তাহা আক্ষেপ উক্তি। “মেছোহাটাই বলো আর ‘প্রার্থনা মন্দিরই বলো আমি কোথা হইতেও ফরমাশ দিয়া কথা আমদানি করি নাই- অামি বাণিজ্য-ব্যবসায়ের ধার ধারি না- হৃদয় হইতে উৎসারিত না হইলে সে কথা আমার মুখ দিয়া বাহির হইত না, যিনি বিশ্বাস করেন করুন, না করেন নাই করুন। বঙ্কিমবাবু বলিয়াছেন— প্রথম সংখ্যক “প্রচার’ বাহির হওয়ার পর রবীন্দ্রবাবুর সহিত আমার চার-পাঁচ বার দেখা হইয়াছিল এবং প্রধানত সাহিত্য সম্বন্ধে কথোপকথন হইয়াছিল, তিনি কেন আমাকে প্রচারের উক্ত প্ৰবন্ধ সম্বন্ধে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করেন নাই ? করি নাই বটে, কিন্তু তাহাতে কী আসে যায়! মূল কথাটার সহিত তাহার কী যোগ? না করিবার অনেক কারণ থাকিতে পারে। সে-সব ঘরের কথা। পাঠকদের বলিবার নহে। বর্তমান লেখকের নানা দোষ থাকিতে পারে। দুর্বলম্বভাবশত আমার চক্ষুলজা হইতে পারে। বঙ্কিমবাবু পাছে বিরোধী মত সহিতে না পারিয়া আমাকে ভুল বুঝেন এমন আশঙ্কা মনে উদয় হইতে পারে। প্রথম যখন পড়িয়ছিলাম তখন স্বাভাবিক অনবধানতা বা মন্দবুদ্ধিবশত উক্ত কয়েক ছত্রের গুরুত্ব উপলব্ধি না করিতে পারি। কিছুদিন পরে অন্য কোনো ব্যক্তির মুখে এ সম্বন্ধে আলোচনা শুনিয়া আমার মনে আঘাত লাগিতেও পারে। উক্ত প্ৰবন্ধ দ্বিতীয়বার পড়িবার সময় আমার মনে নূতন ভাব উদয় হওয়াও অসম্ভব নহে। কিন্তু, প্রকৃত কারণ এই যে, বাড়িতে ‘প্রচার’ আসিবামাত্র কে কোন দিক হইতে লইয়া যায় খুজিয়া পাওয়া যায় না। এইজন্য ভালো করিয়া পড়িতে প্ৰায় বিলম্ব হইয়া যায়। আমার মনে আছে প্ৰথম খণ্ড প্রচার একটি পুস্তকালয়ে গিয়া চোখ বুলাইয়া দেখিয়া আসি। সকল লেখা পড়িতে পাই নাই। পরে একদিন শ্ৰীযুক্ত বাবু নগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মুখে হিন্দুধর্ম নামক প্রবন্ধের মর্মটা শুনি কিন্তু তিনি সত্য-মিথ্যা বিষয়ে কোনো উল্লেখ করেন নাই। পরে সুবিধা অথবা অবসর অনুসারে বহু বিলম্বে উক্ত প্ৰবন্ধ প্রচারে পড়িতে পাই। কিন্তু এ-সকল কথা কেন ? আমার প্রবন্ধে আমি যদি কোনো অন্যায় কথা না বলিয়া থাকি তাহা হইলে আমার আর কোনো দুঃখ নাই। আমার নিজের সম্বন্ধে যাহা বক্তব্য তাহা বলিলাম। এখন আর দুই-একটি কথা আছে। বঙ্কিমবাবুর লেখার ভাব এই যে, তিনি রবীন্দ্রনাথ নামক ব্যক্তিবিশেষের লেখার উত্তর দেওয়া আবশ্যক বিবেচনা করিতেন না। যদি না উক্ত রবীন্দ্ৰনাথ আদি ব্রাহ্মসমাজের সহিত লিপ্ত থাকিতেন। বাস্তবিকই আমি বঙ্কিমবাবুর সহিত মুখোমুখি উত্তর-প্রত্যুত্তর করিবার যোগ্য নহি, তিনিই আমার স্পর্ধা বাড়াইয়াছেন। তবে, বঙ্কিমবাবুর হস্ত হইতে বজ্ৰাঘাত পাইবার সুখ ও গর্ব। অনুভব করিবার জন্যই আমি লিখি নাই, বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর বলিয়া আমার জ্ঞান হইয়াছিল, তাই আমার কর্তব্যকাৰ্য সাধন করিয়াছি। নহিলে সাধ করিয়া বঙ্কিমবাবুর বিরুদ্ধে দাঁড়াইতে আমার প্রবৃত্তিও হয় না ভরসাও হয় না। যাহা হউক, আলোচ্য বিষয়ের গীেরবের প্রতি লক্ষ্যে করিয়া বঙ্কিমবাবু উত্তর লিখিতে প্ৰবৃত্ত হন নাই; তিনি আমার প্রবন্ধকে উপলক্ষ মাত্র করিয়া আদি ব্ৰাহ্মসমাজকে দুই-এক কথা বলিয়াছেন। প্রথম কথা এই যে, আদি ব্রাহ্মসমাজের লেখকেরা