পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬০৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ffyg avy লাফালাফি করিয়া বাহিরে গিয়া দেখি- কী চমৎকার দৃশ্য! শীতে জ্যোৎস্না-স্তর যেন জমিয়া জমিয়া, রাস্তায়, ঘাসের উপর, গাছের শূন্য ডালে, গড়ানো স্নেটের হাতে পুঞ্জীভূত হইয়া আছে। পথে লোক নাই। আমাদের সম্মুখের গৃহশ্রেণীর জানলা দরজা সমস্ত বন্ধ। সেই রাত্রি ও নির্জনতা, জ্যোৎস্না ও বরফ সমস্ত মিলিয়া কেমন এক অপূর্ব দৃশ্য সৃজন করিয়াছিল। ছেলেরা (এবং আমিও) ঘাসের উপর হইতে বরফ কুড়াইয়া পাকাইয়া গোলা করিতেছিল। সেগুলো ঘরে আনিতেই ঘরের তাতে গালিয়া জল হইয়া যাইতে লাগিল। আমার পক্ষে এই প্ৰথম বরফ পড়া রাত্রি। ইহার পরে আরও অনেক বরফ পড়া দেখিয়াছি। কিন্তু তাহার বর্ণনা করা সহজ নহে; বিশেষত এতদিন পরে। সর্বাঙ্গ কালো গরম কাপড়ে আচ্ছন্ন; রাস্তা দিয়া চলিয়াছি। আকাশ ধূসর বর্ণ। গুড়িগুড়ি বরফ কুইনাইনের গুড়ার মতো চারি দিকে পড়িতেছে। বৃষ্টির মতো টপটপ করিয়া পড়ে না- লঘুচরণে উড়িয়া উড়িয়া নাচিয়া নাচিয়া পড়ে। কাপড়ের উপরে আসিয়া ভূঁইয়া থাকে, ঝাড়িলেই পড়িয়া যায়। চারি দিক শুভ্ৰ। কোমল বরফের স্তরের উপর গাড়ির চাকার দাগ পড়িয়া যাইতেছে। শুভ্র বরফের আস্তরণের উপরে কাদাসূদ্ধ জুতার পদচিহ্ন ফেলিতে কেমন মায়া হয়। মনে হয়, স্বৰ্গ হইতে যেন ফুলের পাপড়ি, যেন পারিজাতের কেশর ঝরিয়া পড়িতেছে। পথিকদের কালো কাপড়ে কালো ছাতায় বরফ লাগিয়াছে। কেমন অল্পে অল্পে সমস্ত বরফে আচ্ছন্ন হইয়া আসে। প্ৰথমে পথে ঘাটে সাদা-সাদা রেখারেখার মতো পড়িতে লাগিল। আমাদের বাড়ির সম্মুখেই অল্প একটুখানি জমি আছে, তাহাতে খানকতক গাছের চারা ও গুল্ম আছে- গাছে পাতা নাই, কেবল উটিা সার; সেই ডাঁটাগুলি এখনও আচ্ছন্ন হয় নাই- সবুজে সাদায় মেশামেশি হইতেছে। গাছের চারাগুলো যেন শীতে ভিতরকার রস যেন জমিয়া যাইতেছে। বাড়ির কালো প্লেটের চাল অল্প অল্প পাণ্ডুবৰ্ণ হইয়া ক্রমে সাদা হইয়া উঠিতেছে। ক্রমে পথ আচ্ছন্ন হইয়া গেল— ছােটাে ছোটাে চারা বরফে ডুবিয়া গেল। জানালার সম্মুখে সংকীর্ণ আলিসার উপরে বরফের স্তর উঁচু হইয়া উঠিতে লাগিল। যে দুইএকজন পথিক দেখা যায়, তাহাদের নাক নীল হইয়া গিয়াছে, মুখ শীতে সংকুচিত। অদূরে গির্জার চুড়া শ্বেতবসন প্রেতের মতো আকাশে আবছায়া দেখা যাইতেছে। শীত যে কতখানি তাহা এই ভদ্রমাসের গুমটে কল্পনা করা বড়ো শক্ত। মনে আছে, সকালে ঠাণ্ডা জলে স্নান করিয়া হাত এমন অসাড় হইয়া যাইত যে, পকেটে রুমাল খুঁজিয়া পাইতাম না। গায়ে গরম কাপড়ের সীমা পরিসীমা নাই- মোটা জুতো ও মোটা মোজার মধ্যে পায়ের তেলো দুটাে কথায় কথায় হিম হইয়া উঠিত। রাত্রে কম্বলের বস্তার মধ্যে প্রবেশ করিয়াও পাশ ফিরিতে নিতান্ত ভাবনা উপস্থিত হইত, কারণ যেখানে ফিরিব সেইখানেই ছ্যাক করিয়া উঠিবে। শুনা গেল, একটা জেলে-নীেকায় চারজন জেলে সমুদ্রে মাছ ধরিতে গিয়াছিল, কোনো জাহাজের গাড়ির উপরে গাড়ির কোচমান মরিয়া আছে। জলের নলের মধ্যে জল জমিয়া মাঝে মাঝে নল ফাটিয়া যায়। টেমস নদীর উপরে বরফ জমিয়াছে। হাইডুপার্ক নামক উদ্যানের ঝিল জমিয়া গেছে। প্রতিদিন শতসহস্ৰ লোক একপ্রকার লৌহপিাদুকা পরিয়া সেই ঝিলের উপর স্কেট করিতে 开国亦5 এই স্কেট করা এক অপূর্ব ব্যাপার। কঠিন জলাশয়ের উপর শতসহস্ৰ লোক স্কেটজুতা পরিয়া চলাও তেমনি- শরীর ঈষৎ হেলাইয়া মাটির উপর দিয়া কেমন অবলীলাক্রমে ভাসিয়া যাওয়া যায়। পদক্ষেপ করিবার পরিশ্রম নাই- মাটির সহিত বিবাদ করিয়া, পদাঘাতের দ্বারা প্রতিপদে মাটিকে পরাভূত করিয়া চলিতে হয় না।