পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চার অধ্যায় ᏔᏱᏄᏜ এমন সময় সুরেশ কোনাে প্রদেশের বড়ো শহরে যখন আছেন এল এল তার ঘরে ; রূপে গুণে বিদায় কাকার মনে গর্ব জাগিয়ে তুললে । ওঁর উপরিওয়ালা বা সহকমী এবং দেশী ও বিলিতি মালাপী-পরিচিতদের কাছে নানা উপলক্ষে এলাকে প্রকাশিত করবার জন্যে তিনি ব্যগ্র হয়ে উঠলেন । এলাৱ স্ত্রীবৃদ্ধিতে বুঝতে বাকি রইল না যে, এর ফল ভালো হচ্ছে না । মাধবী মিথ্যা আরামের ভান করে ক্ষণে ক্ষণে বলতে লাগলেন, “র্বাচা গেল— বিলিতি কায়দার সামাজিকতার দায় আমার ঘাড়ে চাপানো কেন বাপু । আমার না আছে বিদ্যে, না আছে বুদ্ধি ।” ভাবগতিক দেখে এলা নিজের চারি দিকে প্রায় একটা জেনানা খাড়া করে তুললে । সুরেশের মেয়ে সুরমার পড়বার ভার সে অতিরিক্ত উৎসাহের সঙ্গে নিলে। একটা গ্ৰীসিস লিখতে লাগিয়ে দিলে তার বাকি সময়টুকু। বিষয়টা বাংলা দুঙ্গলকাব্য ও চসারের কাব্যের তুলনা | এই নিয়ে সুরেশ মহা উৎসাহিত । এই সংবাদটা চার দিকে প্রচার করে দিলেন । মাধবী মুখ বাকা করে বললেন, “বাড়াবাড়ি ।” স্বামীকে বললেন, “এলার কাছে ফস করে মেয়েকে পড়তে দিলে ! কেন, অধর মাস্টার কী দোষ করেছে ? যাই বল না। আমি কিন্তু--” সুরেশ অবাক হয়ে বললেন, “কী বল তুমি ! এলার সঙ্গে অধরের তুলনা ?” “দুটাে নোট বই মুখস্থ করে পাস করলেই বিদ্যে হয় না”— বলে ঘাড় বেঁকিয়ে গৃহিণী ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন । একটা কথা স্বামীকে বলতেও তার মুখে বাধে- ‘সুরমার বয়স তেরো পেরোতে চলল, আজ বাদে কাল পাত্র খুঁজতে দেশ বেঁটিয়ে বেড়াতে হবে, তখন এলা সুরমার কাছে থাকলে— ছেলেগুলোর চোখে যে ফ্যাকাশে কটা রঙের নেশা- ওরা কি জানে কাকে বলে সুন্দর ? দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন। আর ভাবেন, এ-সব কথা কর্তাকে জানিয়ে ফল নেই, পুরুষরা যে সংসার-কানা । যত শীঘ্ৰ হয় এলার বিয়ে হয়ে যাক এই চেষ্টায় উঠে পড়ে লাগলেন গৃহিণী । বেশি চেষ্টা করতে হয়। না, ভালো ভালো পাত্র আপনি এসে জোটে— এমন সব পােত্র, সুরমার সঙ্গে যাদের সম্বন্ধ ঘটাবার জন্য মাধবী। লুব্ধ হয়ে ওঠেন । অথচ এলা। তাদের বারে বারে নিরাশ করে ফিরিয়ে দেয় । ভাইঝির একগুয়ে অবিবেচনায় উদবিগ্ন হলেন সুরেশ, কাকী হলেন অত্যন্ত অসহিষ্ণু । তিনি জানেন সংপাত্রকে উপেক্ষা করা সমর্থবয়সের বাঙালি মেয়ের পক্ষে অপরাধ। নানারকম বয়সোচিত দুর্যোগের আশঙ্কা করতে লাগলেন, এবং দায়িত্ববোধে অভিভূত হল তার অন্তঃকরণ। এলা স্পষ্টই বুঝতে পারলে যে, সে তার কাকার মেহের সঙ্গে কাকার সংসারের দ্বন্দ্ব ঘটাতে বসেছে । এমন সময়ে ইন্দ্রনাথ এলেন সেই শহরে । দেশের ছাত্রেরা তাকে মানত রাজ-চক্রবর্তীর মতো । অসাধারণ তার তেজ, আর বিদ্যার খ্যাতিও প্রভৃত । একদিন সুরেশের ওখানে তার নিমন্ত্রণ । সেদিন কোনো এক সুযোগে এলা অপরিচয়সত্ত্বেও অসংকোচে তার কাছে এসে বললে, “আমাকে আপনার কোনো- একটা কাজ দিতে পারেন না ?” আজকালকার দিনে এরকম আবেদন বিশেষ আশ্চর্যের নয়। কিন্তু তবু মেয়েটির দীপ্তি দেখে চমক লাগল ইন্দ্রনাথের । তিনি বললেন, “কলকাতায় সম্প্রতি নারায়ণী হাই স্কুল মেয়েদের জন্যে খোলা হয়েছে | তোমাকে তার কত্ৰীপদ দিতে পারি, প্ৰস্তুত আছ ?” ইন্দ্রনাথ এলার মুখের দিকে তার উজ্জ্বল দৃষ্টি রেখে বললেন, “আমি লোক চিনি । তোমাকে বিশ্বাস করতে আমার মুহুর্তকাল বিলম্ব হয় নি। তোমাকে দেখবামােত্রই মনে হয়েছে, তুমি নবযুগের দূতী, নবযুগের আহবান তোমার মধ্যে !” হঠাৎ ইন্দ্রনাথের মুখে এমন কথা শুনে এলার বুকের মধ্যে কেঁপে উঠল । সে বললে, “আপনার কথায় আমার ভয় হয় । ভুল করে আমাকে বাড়াবেন না । আপনার ধারণার যোগ্য হবার জন্যে দুঃসাধ্য চেষ্টা করতে গেলে ভেঙে পড়বা। আমার শক্তির সীমার মধ্যে যতটা পারি বঁচিয়ে চলব। আপনার আদর্শ, কিন্তু ভান করতে পারব না।” Գt|ՀÇ