পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চার অধ্যায় \SA অমানুষিক অত্যাচারের খবর প্রায় শুনতে পাই, আর দেখি তার প্রধান নায়িকা শাশুড়ি । কিন্তু শাশুডিকে অপ্রতিহত অন্যায় করবার অধিকার দিয়েছে কে ? সে তো ঐ মায়ের খোকারা । অত্যাচারিণীর বিরুদ্ধে নিজের স্ত্রীর সম্রাম রাখবার শক্তি নেই যাদের সেই নাবালকদের কখনোই কি বিয়ে করবার বয়স হয় ? যখন হয় তখন তারা স্ত্রীর খোকা হয়ে ওঠে । যেখানে পুরুষের পৌরুষ দুর্বল সেখানেই মেয়েরা নেবে আসে আর নাবায় নীচতার দিকে । আজ দেখি আমাদের দেশে যারা বড়ো, কিছু করবার সংকল্প করে তারা মেয়েকে ত্যাগ করতে চায়— মেয়েকে ভয় করে সেই ন্ত্রৈণ কাপুৰুষেরা । সেইজন্যেই এই কাপুরুষের দেশে তুমি পণ করেছ বিয়ে করবে না, পাছে কোনো কচি মন বেঁকে যায় তোমার মেয়েলি প্রভাবে । যথার্থ পুরুষ যারা তারা যথার্থ মেয়ের জোরেই চরিতার্থ হবে- বিধাতার নিজের হাতের এই হুকুমনামা আছে আমাদের রক্তে | যে সেই বিধিলিপিকে ব্যর্থ করে সে পুরুষ নামের যোগ্য নয়। পরীক্ষার ভার ছিল তোমার হাতে, আমাকে পরীক্ষা করে দেখলে না কেন ?" “অস্তু, তৰ্ক করতে পারতুমি কিন্তু তোমার সঙ্গে তর্ক করব না । কেননা, জানি তুমি নিতান্ত ক্ষোভের মুখে এই-সব কুযুক্তি পেড়েছি। আমার পণের কথা কিছুতেই ভুলতে পারিছ না।” “না ভুলতে পারব না । তুমি বললে কি না, পুরুষেরা মস্ত বড়ো, মেয়েরা তাদের ছোটাে করবে। এই তোমার ভয় ! মেয়েদের বড়ো হবার দরকারই হয় না । তারা যতটুকু ততটুকুই সুসম্পূর্ণ। হতভাগা যো-পুরুষ বড়ো নয় সে অসম্পূর্ণ, তার জন্যে সৃষ্টিকর্তা লজ্জিত ।” “অস্তু, সেই অসম্পূর্ণের মধ্যেও আমরা বিধাতার ইচ্ছাটা দেখতে পাই— সেটা বড়ো ইচ্ছা ।” “এলী, বিধাতার ইচ্ছাটাই যে বড়ো, তা বলতে পারি নে, তার কল্পনাটাও কোনাে অংশে ছােটাে নয় ! সেই কল্পনার তুলির ছোওয়ায় জাদু লেগেছে মেয়েদের প্রকৃতিতে, তারা সংসারের ক্ষেত্রে এনেছে আটিস্টের সাধনা, রঙে সুরে আপনি দেহে মনে প্ৰাণে অনির্বচনীয়কে প্রকাশ করছে। এটা সহজ শক্তির কম, সেইজন্যেই এটা সহজ নয় । ঐ যে তোমার শাখের মতো চিকন রঙের কণ্ঠে সোনার হারটি দেখা দিয়েছে ওর জনো তোমাকে নোটবই মুখস্থ করতে হয় নি। আপনার জীবনলোকে রূপের সৃষ্টিতে রস জোগাতে পারল না। এমন হতভাগিনী আছে, মোটা সোনার বালা পরে গিল্পীপনা করে সেই মুখরা ; নয় তো দাসী হয়ে জীবন কাটায় উঠোন নিকিয়ে । সংসারে এইসব অকিঞ্চিৎকারের সীমাসংখ্যা নেই ।” ”সৃষ্টিকর্তাকেই দোষ দেব অন্তু । লড়াই করবার শক্তি কেন দেন নি মেয়েদেব ? বঞ্চনা করে কেন তাদের আপনাকে বাচাতে হয় ? পৃথিবীতে সব-চেয়ে জঘন্য যে স্পাইয়ের ব্যাবসা সেই ব্যাবসাতে মেয়েদের নৈপুণ্য পুরুষের চেয়ে বেশি, এ-কথা যখন বইয়ে পড়লুম। তখন বিধাতার পায়ে মাথা ঠুকে বলেছি, সাতজন্মে যেন মেয়ে হয়ে না জন্মাই । আমি মেয়ের চোখে দেখেছি। পুরুষকে, তাই সব কাটিয়ে তাদের ভালোকে দেখতে পেয়েছি, তাদের বড়োকে । যখন দেশের কথা ভাবি তখন সেই-সব সোনার টুকরো ছেলেদের কথাই ভাবি, আমার দেশ তারাই ; তারা ভুল যদি করে, খুব বড়ো করেই ভুল করে । আমার বুক ফেটে যায় যখন ভাবি আপন ঘরে এরা জায়গা পেল না। আমি ওদেরই মা, ওদেরই বোন, ওদেরই মেয়ে— এই কথা মনে করে বুক ভরে ওঠে আমার । নিজেকে সেবিকা বলতে ইংরেজি-পড়া মেয়েদের মুখে বাধে- কিন্তু আমার সমস্ত হৃদয় বলে ওঠে। আমি সেবিকা, তোমাদের সেবা করা আমার সার্থকতা ! আমাদের ভালোবাসার চরম এই ভক্তিতে ।” "ভালোই তো ; তোমার সেই ভক্তির জন্যে অনেক পুরুষ আছে, কিন্তু আমাকে কেন ? ভক্তি না হলেও আমার চলবে । মেয়েদের সম্বন্ধের যে ফর্দটা তুমি দিলে, মা বোন মেয়ে, তার মধ্যে প্রধান একটা বাদ পড়ে গেল, আমারই কপালদোযে ।” "তোমার নিজের চেয়ে তোমাকে আমি বেশি জানি অস্তু । আমার আদরের ছোটাে খাচায় দুদিনে তোমার ডানা উঠত। ছটফটিয়ে । যে-তৃপ্তির সামান্য উপকরণ আমাদের হাতে, তার আয়োজন তোমার কাছে একদিন ঠেকত তলানিতে এসে । তখন জানতে পারতে আমি কতই গরিব । তাই আমার সমস্ত দাবি তুলে নিয়েছি, সম্পূর্ণমনে সঁপে দিয়েছি তোমাকে দেশের হাতে । সেখানে তোমার শক্তি