পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8Q8 − রবীন্দ্র-রচনাবলী অবহেলা করিতেন না, ছেলেদের কোলে লইয়া বসাইতেন, জননীদিগকে ঘরকন্নার কথা জিজ্ঞাসা করিতেন। নারীসমাজে অল্পকালের মধ্যেই তঁহার অত্যন্ত প্রতিপত্তি হইল। তাহার কাছে পুরুষও বিস্তর আসিত । কোনোদিন ভাগবত পাঠ করিতেন, কোনোদিন ভগবদগীতার ব্যাখ্যা করিতেন, কোনোদিন মন্দিরে বসিয়া নানা শাস্ত্ৰ লইয়া আন্দোলন করিতেন । তাহার নিকটে কেহ উপদেশ লইতে আসিত, কেহ মন্ত্র লাইতে আসিত। কেহ রোগের ঔষধ জানিতে আসিত । মেয়েরা ঘাটে আসিয়া বলাবলি করিতে- আহা কী রূপ ! মনে হয় যেন মহাদেব সশরীরে তাহার মন্দিরে আসিয়া অধিষ্ঠিত হইয়াছেন । যখন সন্ন্যাসী প্রতিদিন প্রত্যুষে সূর্যোদয়ের পূর্বে শুকতারাকে সম্মুখে রাখিয়া গঙ্গার জলে নিমগ্ন হইয়া ধীরগভীরস্বরে সন্ধ্যাবন্দনা করিতেন, তখন আমি জলের কল্লোল শুনিতে পাইতাম না । তাহার সেই কণ্ঠস্বর শুনিতে শুনিতে প্রতিদিন গঙ্গার পূর্ব উপকূলের আকাশ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিত, মেঘের ধারে ধারে অরুণ রঙের রেখা পড়িত, অন্ধকার যেন বিকাশোন্মুখ কুঁড়ির আবরণ-পুটের মতো ফাটিয়া চারিদিকে নামিয়া পড়িত ও আকাশ-সরোবরে উষাকুসুমের লাল আভা অল্প অল্প করিয়া বাহির হইয়া আসিত । আমার মনে হইত যে, এই মহাপুরুষ গঙ্গার জলে দাড়াইয়া পূর্বের দিকে চাহিয়া যে এক মহামন্ত্র পাঠ করেন তাঁহারই এক-একটি শব্দ উচ্চারিত হইতে থাকে আর নিশীথিনীর কুহক ভাঙিয়া যায়, চন্দ্র-তারা পশ্চিমে নামিয়া পড়ে, সূর্য পূর্বকাশে উঠিতে থাকে, জগতের দৃশ্যপট পরিবর্তিত হইয়া যায়। এ কে মায়াবী । স্নান করিয়া যখন সন্ন্যাসী হােমশিখার ন্যায় তাহার দীর্ঘ শুভ্ৰ পুণ্যতনু লইয়া জল হইতে উঠিতেন, তাহার জটাজুট হইতে জল ঝরিয়া পড়িত, তখন নবীন সূর্যকিরণ র্তাহার সর্বঙ্গে পড়িয়া প্রতিফলিত হইতে থাকিত । । এমন আরো কয়েক মাস কাটিয়া গেল। চৈত্র মাসে সূর্যগ্রহণের সময় বিস্তর লোক গঙ্গামানে আসিল । বাবলাতলায় মস্ত হাট বসিল । এই উপলক্ষে সন্ন্যাসীকে দেখিবার জন্যও লোকসমাগম হইল । যে গ্রামে কুসুমের শ্বশুরবাড়ি সেখান হইতেও অনেকগুলি মেয়ে আসিয়াছিল। সকালে আমার ধাপে বসিয়া সন্ন্যাসী জপ করিতেছিলেন, তাহাকে দেখিয়াই সহসা একজন মেয়ে আর-একজনের গা টিপিয়া বলিয়া উঠিল, “ওলো, এ যে আমাদের কুসুমের স্বামী ।” আর-একজন দুই আঙুলে ঘোমটা কিছু ফাক করিয়া ধরিয়া বলিয়া উঠিল, “ওমা, তাই তো গা, এ যে আমাদের চাটুজ্যেদের বাড়ির ছোটােদাদাবাবু।” সুতুবুন্টু মােটর বড়ো ঘটা করত না, সে কহিল,”আহ, তেমনি কপাল, তেমনি না, 05ों२ |” আর-একজন সন্ন্যাসীর দিকে মনোযোগ না করিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া কলসী দিয়া জল ঠেলিয়া বলিল, “আহা সে কি আর আছে। সে কি আর আসবে। কুসুমের কি তেমনি কপাল।” তখন কেহ কহিল, “তার এত দাড়ি ছিল না।” কেহ বলিল, “সে এমন একহারা ছিল না ।” কেহ বলিল, “সে যেন এতটা লম্বা নয়।” এইরূপে এ কথাটার একরূপ নিম্পত্তি হইয়া গেল, আর উঠিতে পাইল না । গ্রামের আর সকলেই সন্ন্যাসীকে দেখিয়াছিল, কেবল কুসুম দেখে নাই। অধিক লোকসমাগম হওয়াতে কুসুম আমার কাছে আসা একেবারে পরিত্যাগ করিয়াছিল। একদিন সন্ধ্যাবেলা পূর্ণিমা তিথিতে চাঁদ উঠতে দেখিয়া বুঝি আমাদের পুরাতন সম্বন্ধ তাহার মনে পড়িল । তখন ঘাটে আর কেহ লোক ছিল না। ঝিঝি পোকা ঝি বি করিতেছিল। মন্দিরে কঁাসির ঘণ্টা বাজা এই কিছুক্ষণ হইল শেষ হইয়া গেল, তাহার শেষ শব্দতরঙ্গ ক্ষীণতর হইয়া পরপারের ছায়াময় বনশ্রেণীর মধ্যে ছায়ার মতো মিলাইয়া গেছে। পরিপূর্ণ জ্যোৎস্না। জোয়ারের জল ছল ছল করিতেছে। আমার উপরে ছায়াটি ফেলিয়া কুসুম বসিয়া আছে। বাতাস বড়ো ছিল না, গাছপালা নিস্তব্ধ। কুসুমের সম্মুখে গঙ্গার বক্ষে অবারিত প্রসারিত জ্যোৎস্না— কুসুমের পশ্চাতে আশে পাশে