পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8brケ রবীন্দ্র-রচনাবলী সন্তানকে এবং আপনার দলকেও অতিক্রম করিয়া গেছে, সেইখনেই আমরা মনুষ্যত্বের পূর্ণশক্তির বিকাশে পরম গৌরব লাভ করিয়াছি। বুদ্ধদেবের করুণা সন্তানবাৎসল্য নহে, দেশানুরাগও নহে— বৎস যেমন গাভী-মাতার পূর্ণস্তন হইতে দুগ্ধ আকর্ষণ করিয়া লয়, সেইরূপ ক্ষুদ্র অথবা মহৎ কোনাে-শ্রেণীর স্বাৰ্থপ্রবৃত্তি সেই করুণাকে আকর্ষণ করিয়া লইতেছে না। তাহা জলভারাক্রান্ত নিবিড় মেঘের ন্যায় আপনার প্রভূত প্রাচুর্যে আপনাকে নির্বিশেষে সর্বলোকের উপরে বর্ষণ করিতেছে। ইহাই পরিপূর্ণতার চিত্র, ইহাই ঐশ্বর্য। ঈশ্বর প্রয়োজনবশত নহে, শক্তির অপরিসীম প্রাচুর্যবশতই আপনাকে নির্বিশেষে নিয়তই বিশ্বরূপে দান করিতেছেন। মানুষের মধ্যেও যখন আমরা সেইরূপ শক্তির প্রয়োজনাতীত প্রাচুর্য ও স্বতঃপ্রবৃত্ত উৎসর্জন দেখিতে পাই, তখনই মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের প্রকাশ বিশেষভাবে অনুভব করি । বুদ্ধদেব বলিয়াছেন— মাতা যথা নিযং পুত্তং আয়ুসা একপুত্তমন্নুরকখে । এবম্পি সব্বভুতেসু মানসম্ভাবযে অপরিমাণং। মেত্তঞ্চ সকবলোকস্মিং মানসম্ভাবযে অপরিমাণং | উদ্ধং অধো চ তিরিযঞ্চ অসম্বাধং অবেরমসপাত্তং ॥ তিটুঠঞ্চরং নিসিন্নো বা সয়ানো বা যাবতসস বিগতমিদ্ধো । এতাং সতিং অধিটঠেযং ব্ৰহ্মমেতং বিহারমিধমাহু ॥ মাতা যেমন প্ৰাণ দিয়াও নিজের পুত্রকে রক্ষা করেন, এইরূপ সকল প্রাণীর প্রতি অপরিমাণ দয়াভােব জন্মাইবে । উর্ধর্বদিকে, অধােদিকে, চতুর্দিকে সমস্ত জগতের প্রতি বাধ্যাশনা, হিংসাশূন্য, শত্ৰুতাশূন্য মানসে অপরিমাণ দয়াভােব জন্মাইবে । কি দাড়াইতে, কি চলিতে, কি বসিতে, কি শুইতে, যাবৎ নিদ্রিত না হইবে, এই মৈত্রভাবে অধিষ্ঠিত থাকিবে— ইহাকেই ব্ৰহ্মবিহার বলে । এই যে ব্ৰহ্মবিহারের কথা ভগবান বুদ্ধ বলিয়াছেন, ইহা মুখের কথা নহে, ইহা অভ্যস্ত নীতিকথা নহে- আমরা জানি, ইহা তাহার জীবনের মধ্য হইতে সত্য হইয়া উদ্ভূত হইয়াছে। ইহা লইয়া অদ্য আমরা গৌরব করিব | এই বিশ্বব্যাপী চিরজাগ্রত করুণা, এই ব্ৰহ্মবিহার, এই সমস্ত-আবশ্যকের অতীত অহেতুক অপরিমেয় মৈত্রশক্তি, মানুষের মধ্যে কেবল কথার কথা হইয়া থাকে নাই, ইহা কোনো-না-কোনো স্থানে সত্য হইয়া উঠিয়ছিল । এই শক্তিকে আর আমরা অবিশ্বাস করিতে পারি না— এই শক্তি মনুষ্যত্বের ভাণ্ডারে চিরদিনের মতো সঞ্চিত হইয়া গেল । যে মানুষের মধ্যে ঈশ্বরের অপর্যাপ্ত দয়াশক্তির এমন সত্যরূপে বিকাশ হইয়াছে, আপনাকে সেই মানুষ জানিয়া উৎসব করিতেছি । এই ভারতবর্যে একদিন মহাসম্রাট অশোক তাহার রাজশক্তিকে ধর্মবিস্তারকার্যে মঙ্গলসাধনকাযে। নিযুক্ত করিয়াছিলেন। রাজশক্তির মাদকতা যে কী সুতীব্র তাহা আমরা সকলেই জানি— সেই শক্তি ক্ষুধিত অগ্নির মতো গৃহ হইতে গৃহান্তরে গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে দেশ হইতে দেশান্তরে আপনার জ্বালাময়ী লোলুপ রসনাকে প্রেরণ করিবার জন্য ব্যগ্র | সেই বিশ্বলুব্ধ রাজশক্তিকে মহারাজ অশোক মঙ্গলের দাসত্বে নিযুক্ত করিয়াছিলেন- তৃপ্তিহীন ভোগকে বিসর্জন দিয়া তিনি শ্ৰান্তিহীন সেবাকে গ্ৰহণ করিয়াছিলেন । রাজত্বের পক্ষে ইহা প্রয়োজনীয় ছিল না— ইহা যুদ্ধসজ্জা নহে, দেশজয় নহে, বাণিজ্যবিস্তার নহে- ইহা মঙ্গলশক্তির অপর্যাপ্ত প্ৰাচুৰ্য্য— ইহা সহসা চক্রবর্তী রাজাকে আশ্রয় করিয়া তাহার সমস্ত রাজাড়ম্বরকে এক মুহূর্তে হীনপ্ৰভা করিয়া দিয়া সমস্ত মনুষ্যত্বকে সমুজ্জ্বল করিয়া তুলিয়াছে। কত বড়ো বড়ো রাজার বড়ো বড়ো সাম্রাজ্য বিধ্বস্ত বিস্মৃত ধূলিসাৎ হইয়া গিয়াছে— কিন্তু অশোকের মধ্যে এই মঙ্গলশক্তির মহান আবির্ভাব, ইহা আমাদের গৌরবের ধন হইয়া আজও আমাদের মধ্যে শক্তিসঞ্চার করিতেছে। মানুষের মধ্যে যাহা-কিছু সত্য হইয়া উঠিয়াছে, তাহার গৌরব হইতে তাহার সহায়তা হইতে মানুষ আর কোনোদিন বঞ্চিত হইবে না। আজ মানুষের মধ্যে, সমস্ত-স্বৰ্থজয়ী এই অদ্ভুত মঙ্গলশক্তির মহিমা স্মরণ করিয়া আমরা পরিচিত-অপরিচিত সকলে মিলিয়া উৎসব করিতে প্ৰবৃত্ত হইয়াছি। মানুষের এই সকল মহত্ত্ব আজ আমাদের দীনতমকে আমাদের