পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৯২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

( AO a রবীন্দ্র-রচনাবলী শ্যামলতায়, ফুলের গন্ধে সর্বত্রই তার সেই পায়ের চিহ্ন ধরা পড়েছে যে। সেখানে যদি তিনি রাজবেশ ধরে আসতেন তা হলে জোড়হাত করে তাকে মানতুম— কিন্তু তিনি যে বন্ধুর বেশে ধীরপদে আসেন, একেবারে একলা আসেন, সঙ্গে তার পদাতিকগুলো শাসনদণ্ড হাতে জয়ডঙ্কা বাজিয়ে কেউ আসে না— সেইজন্যে পাপ ঘুম ভাঙতেই চায় না, দরজা বন্ধই থাকে। কিন্তু এমন করলে তো চলবে না— শাসনের দায় নেই বলেই লক্ষ্মীছাড়া যদি প্রেমের দায় স্বেচ্ছার সঙ্গে স্বীকার না করে তবে জন্মজন্ম সে কেবল দাস, দাসানুদাস হয়েই ঘুরে মরবে। মানবজন্ম যে আনন্দের জন্ম, সে খবরটা সে যে একেবারে পাবেই না। ওরে, অন্তরের যে নিভৃততম আবাসে চন্দ্ৰসূর্যের দৃষ্টি পীেছোয় না, যেখানে কোনো অন্তরঙ্গ মানুষেরও প্রবেশপথ নেই, যেখানে কেবল একলা পারি, তার আনন্দ, তার ইচ্ছা, তীর প্ৰেম আমার জীবনকে সর্বত্র নীরন্ধ নিবিড়ভাবে পরিবৃত করে আছে। তিনিও পণ করে বসে আছেন তার এই আনন্দমূর্তি তিনি আমাদের জোর করে দেখবেন না— বরঞ্চ তিনি প্রতিদিনই ফিরে ফিরে যাবেন, বরঞ্চ তীর এই জগৎজোড়া সৌন্দর্যের আয়োজন প্রতিদিন আমার কাছে ব্যর্থ হবে। তবু তিনি এতটুকু জোর করবেন না । যেদিন আমার প্ৰেম জগবে সেদিন তার প্রেম আর লেশমাত্র গোপন থাকবে না। কেন যে আমি “আমি” হয়ে এতদিন এত দুঃখে দ্বারে দ্বারে ঘুরে মরেছি, সেদিন সেই বিরহাদুঃখের রহস্য এক মুহূর্তেই ফাঁস হয়ে যাবে। ১৯ পৌষ প্রার্থনার সত্য কেউ কেউ বলেন, উপাসনায় প্রার্থনার কোনো স্থান নেই- উপাসনা কেবলমাত্র ধ্যান | ঈশ্বরের স্বরূপকে মনে উপলব্ধি করা । সে কথা স্বীকার করতে পারতুম যদি জগতে আমরা ইচ্ছার কোনো প্রকাশ না দেখতে পেতুম | আমরা লোহার কাছে প্রার্থনা করি নে, পাথরের কাছে প্রার্থনা করি নে— যার ইচ্ছাবৃত্তি আছে তার কাছেই প্রার্থনা জানাই | ঈশ্বর যদি কেবল সত্যস্বরূপ হতেন, কেবল অব্যৰ্থ নিয়মরূপে তার প্রকাশ হত তা হলে তার কাছে প্রার্থনার কথা আমাদের কল্পনাতেও উদিত হতে পারত না । কিন্তু তিনি নাকি “আনন্দরূপমমৃতং", নে, ইচ্ছার দ্বারাই তীর ইচ্ছাস্বরূপকে আনন্দস্বরূপকে জানতে হয় । পূর্বেই বলেছি জগতে ইচ্ছার একটি নিদর্শন পেয়েছি সৌন্দর্যে। এই সৌন্দর্য আমাদের ইচ্ছাকে জাগ্রত করে এবং ইচ্ছার উপরেই তার নির্ভর । এইজন্য আমরা সৌন্দর্যকে উপকরণরীপে ব্যবহার করি প্রেমের ক্ষেত্রে, প্রয়োজনের ক্ষেত্রে নয় । এই জন্য আমাদের সজ্জা, সংগীত, সৌগন্ধা সেইখানেই, যেখানে ইচ্ছার সঙ্গে ইচ্ছার যোগ, আনন্দের সঙ্গে আনন্দের মিলন । জগদীশ্বর তার জগতে এই অনাবশ্যক সৌন্দর্যের এমন বিপুল আয়োজন করেছেন বলেই আমাদের হৃদয় বুঝেছে, জগৎ একটি মিলনের ক্ষেত্ৰ— নইলে এখানকার এত সাজসজা একেবারেই বাহুল্য । জগতে হৃদয়েরও একটা বোঝবার বিষয় আছে, সে কথা একেবারে উড়িয়ে দিলে চলবে কেন ? একদিকে আলোক আছে বলেই আমাদের চক্ষু আছে ; একদিকে সত্য আছে বলেই আমাদের চৈতন্য আছে— একদিকে জ্ঞান আছে বলেই আমাদের বুদ্ধি আছে ; তেমনি আর একদিকে কী আছে আমাদের মধ্যে হৃদয় হচ্ছে যার প্রতিরূপ ? উপনিষৎ এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন- “রসো বৈ সঃ ”